বর্তমানে সংবাদের শিরোনামে ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহ ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মাথাব্যথার কথা। তবে সত্যিই কি ওয়াগনাররা পুতিনের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন? না কি, গোটা ঘটনাবলির নেপথ্যে রয়েছে বিরাট কোনও ষড়যন্ত্র? খবরে যা দেখা যাচ্ছে তা কতটা সত্যি? গোটাটাই কি কোনও জটিল নাটকের অংশ মাত্র? আর এই ওয়াগনার বিদ্রোহ কি কিউবার সেনা অভ্যুত্থানের মতোই ঘটনা, নাকি একেবারে আলাদা? বিশ্লেষণে মণিশংকর চৌধুরী।
‘মার্সিনারি’- যার বাংলা অর্থ হয় ভাড়াটে সৈন্য। আজ থেকে নয়, মধ্যযুগ থেকেই ইউরোপে ভাড়াটে সেনাদের দাপট দেখা গিয়েছে। পঞ্চদশ শতকের আশপাশে ‘উংগড হুসার’দের দেখা গিয়েছিল ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে। ঘোড়ায় চেপে পিঠে পাখা লাগিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে নেমে আসত এই হুসাররা। একইভাবে জানা যায়, জার্মান মার্সিনারি বাহিনী Landsknechte (ল্যান্ডসকেনেস্ট) বা স্প্যানিশ ফারফানদের কথাও। নিকোলাই অস্ত্রভস্কির উপন্যাস ‘ইস্পাতে’ ইউক্রেন ও রাশিয়ার কসাক ঘোড়সওয়ারদের খুরের আওয়াজ কল্পনা করে এখনও পাঠক শিহরিত হন। এই আধুনিক যুগেও ‘মার্সিনারি’-র বেজায় কদর।
আরও শুনুন: মোদিকে সংখ্যালঘু-প্রশ্ন করে বিদ্রুপের শিকার, ভারতের জার্সি গায়ে ‘জবাব’ সেই মুসলিম সাংবাদিকের
সময় পালটেছে। বর্শার জায়গা নিয়েছে বন্দুক। তির-কামানের বদলে এসেছে মিসাইল। তবে কড়ি ফেললে আজও প্রাণের সওদাগরদের পাওয়া যায়। আফগানিস্তানে ও ইরাকে ‘প্রাইভেট কন্ট্রাক্টার’ নামের আড়ালে ভাড়াটে বেসরকারি বাহিনী ব্যবহার করেছে এবং করছে আমেরিকা। ঠিক তেমনই রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল বা মার্সিনারি ফোর্স হচ্ছে ওয়াগনার গ্রুপ। দলটির প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। ১৯৬১ সালে লেনিনগ্রাদে জন্ম প্রিগোজিনের (Yevgeny Prigozhin)। শৈশব ছিল বিপন্ন। চিলড্রেনস হোম ও কিশোর সংশোধনাগারে কেটেছে ছেলেবেলার অনেকটাই সময়। কেরিয়ার শুরু রাঁধুনি হিসেবেই। কিন্তু ক্রমেই তিনি হয়ে উঠতে থাকেন বিতর্কিত চরিত্র। একসময় ডাকাতির অভিযোগে জেলের অন্দরেও কাটিয়েছেন কিছুদিন। ভাবতে অবাক লাগে, আজ যিনি পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন, একদা তিনিই ছিলেন তাঁর এক বিশ্বস্ত সহচর। তাঁকে বলা হত ‘পুতিনের রাঁধুনি’। আসলে ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহ করত প্রিগোজিনেরই রেস্তোরাঁ ও কেটারিং সংস্থা। ২০১৪ সালে পুতিনের মদতেই ওয়াগনার তৈরি করেন প্রিগোজিন। ওই সংস্থার পাশাপাশি আরও তিনটি সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি, যেগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল ২০১৬ ও ২০১৮ সালের মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাঁর উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রেখেছে। সিরিয়া, লিবিয়া, ইউক্রেনে যুদ্ধ করেছে তাঁর ভাড়াটে সেনাবাহিনী।
আরও শুনুন: রাশিয়ার নীতির ফলে দুর্ভিক্ষ তৈরি হয় ইউক্রেনে, মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ১ কোটি মানুষের
গত শনিবার এহেন প্রিগোজিন বন্ধু পুতিনের বিরুদ্ধে আচমকা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পুতিনের পালটা হুমকির পরই মস্কোর (Mosco) দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, সামনে যা পাবেন তাই গুঁড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার হুঙ্কার দেওয়া ‘পুতিনের রাঁধুনি’ কেন আচমকাই এভাবে পিছু হটলেন? বলা হচ্ছে, এর পিছনে রয়েছেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। তাঁর হস্তক্ষেপেই আপাতত ব্যারাকে ফিরেছে ওয়াগনার।
আরও শুনুন: ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে কতটা বদলাবে ভারত-রাশিয়া-আমেরিকার সম্পর্কের সমীকরণ?
কিন্তু বিশ্লেষকদের একাংশের মতে বিষয়টি যত সহজ মনে হচ্ছে ততটা নয়। পুতিনের নীল নকশা মেনেই কি ওয়াগনার বিদ্রোহ, এহেন প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, শুরু থেকে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমোভের উপর খড়্গহস্ত প্রিগোজিন। ওয়াগনার জওয়ানদের পর্যাপ্ত হাতিয়ার দিচ্ছে না রুশ সেনা বলে গত জানুয়ারি মাস থেকেই অভিযোগ জানিয়েছিলেন প্রিগোজিন। মূলত, সের্গেই শোইগু ও গেরাসিমোভকে গদি থেকে সরাতেই অভিযান বলে প্রকাশ্যে ঘোষণাও করেছেন তিনি। আর পুতিনের সঙ্গে কোনও বিরোধ নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশ তাই মনে করছে, ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ক্রেমলিনের অন্দরে ফাটল ধরেছে। সংঘাত চলছে মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গ লবির মধ্যে। মস্কো লবিতে নাকি রয়েছেন পুতিন ও প্রিগোজিন। আর পিটার্সবার্গ লবিতে স্বমহিমায় শোইগু ও গেরাসিমোভ। ইউক্রেনকে দ্রুত কবজা করায় অসমর্থ হওয়ায় শোইগু ও সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমোভের উপর চটে রয়েছেন পুতিন। তবে সরাসরি তাদের সরিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছেন না তিনি। ফলে ওয়াগনারকে দিয়ে প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলে থাকতে পারেন পুতিন। এবার ব্যবস্থা ফেরানোর নামে ক্রেমলিনে বিরোধী স্বর দমন করতে চলেছেন পুতিন।
অনেকেই আবার বলছেন এই পরিস্থিতির সঙ্গে সুদানের ঘটনাবলির অনেক মিল রয়েছে। কীভাবে, সুদানের বর্তমান গৃহযুদ্ধে প্রতিপক্ষ সে দেশের সশস্ত্র বাহিনীরই দুই জেনারেল— সেনাপ্রধান আবদেল আল ফতা আল বুরহান ও জেনারেল মহম্মদ হামদান দাগালো। প্রথম জন সুদানের সেনাপ্রধান এবং ২০১৯ থেকে দেশের সর্বোচ্চ শাসনব্যবস্থার জন্য ভারপ্রাপ্ত কাউন্সিলের প্রধান। দ্বিতীয় জন দেশের আধাসামরিক বাহিনী ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ (আরএসএফ)-এর প্রধান তথা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। স্বৈরতন্ত্রী শাসক ওমর আল বশির তিরিশ বছর ক্ষমতাসীন থেকে শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের জেরে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন। সেই বশিরই সেনার উপর রাশ ধরে রাখতে পালটা শক্তি হিসেবে তৈরি করেছিলেন আরএসএফ। একইভাবে, বাখমুট দখলের পর থেকেই রাশিয়ায় প্রভাব বাড়ছে ওয়াগনার বাহিনীর। এতে রুশ সেনা উদ্বিগ্ন। শঙ্কা জেগেছে পুতিনের মনেও। তাই দুই বাহিনীকেই কাউন্টার-ওয়েট হিসাবে ব্যবহার করে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছেন ভ্লাদিমির পুতিন। রক্তাক্ত চেচনিয়াতেও একইভাবে রমজান কাদিরভকে কাজে লাগিয়েছিলেন পুতিন। ফলে ওয়াগনার বিদ্রোহ আসলে পুতিনেরই ছক। এমনটা মনে করছেন অনেকেই। আর ঠিক এই জায়গাতেই কিউবা বা ভেনেজুয়েলা যে সশস্ত্র ভাড়াটে সেনা দিয়ে অভ্যুত্থানের সাক্ষী থেকেছে তার থেকে অনেকটাই পৃথক হয়ে যায় প্রিগোজিনের নেতৃত্বে হওয়া সেনা অভ্যুত্থান। ইতিহাসের পরতে পরতে যে রহস্য লুকিয়ে থাকে তা ইতিহাসই ভাবীকালের কাছে ব্যক্ত করে। ফলত আজকের ওয়াগনার বিদ্রোহের নেপথ্যে যে কোন রহস্য খেলা করছে, তা ইতিহাসের পথ ধরেই স্পষ্ট হয়ে যাবে আগামীতে।