মাথার উপরে ঘাই মারছে যুদ্ধবিমান। রাস্তায় টহল দিচ্ছে শত্রুদেশের সেনা। যেদিকে তাকানো যায় গোলাগুলি, বন্দুক আর মৃত্যুমিছিল শুধু। দেখতে দেখতে ৬ দিনে পড়ল ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছেন অসংখ্য ইউক্রেনবাসী। আসলে তো রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, আর বেমক্কা প্রাণ যায় সাধারণ বাসিন্দাদের। যুদ্ধের ভয়ে একদিন ঘটিবাটি বেচে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ইউক্রেনে। ফের এ দেশে এসেও পিছু নিল যুদ্ধ। এ ভাবে যুদ্ধের তাড়া খেয়ে খেয়ে আর কতদূর! কতটা পথ পেরোলে পরে সুস্থ জীবন ফিরে পাবেন আজমলেরা? কীভাবে বেঁচে আছেন তাঁরা? শুনে নিন।
‘যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা,
যুদ্ধ মানেই আমার প্রতি তোমার অবহেলা।’
সত্যি তো, যুদ্ধ দিয়ে কবেই বা কারওর ভাল হয়েছে! যুদ্ধ মানেই তো শুধুই ক্ষয়ক্ষতি আর মৃত্যুমিছিল। আর সেই যুদ্ধ থেকে বাঁচতেই পরিবারকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। এক মুঠো শান্তির খোঁজে এ দেশ থেকে ও দেশ। কিন্তু যুদ্ধ যেন পিছু ছাড়ছে না তাঁদের। দুই সন্তান আর স্ত্রীর কথা ভেবে পালানো ছাড়া সামনে আর কোনও পথ নেই। পালাতে পালাতে ক্লান্ত পরিবার তাই শেষমেশ দুষছেন কপালকেই।
আরও শুনুন: রাশিয়া আক্রমণ করতেই তড়িঘড়ি বিয়ে, একসঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিলেন ইউক্রেনের নবদম্পতি
এক বছর যেতে না যেতেই ফের পিছু নিল সেই ভয়টা। মাথার উপর চক্কর কাটছে যুদ্ধবিমান। যে কোনও সময় কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। এই আতঙ্ক নিয়েই কোনও মতে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন আজমল রহমানি ও তাঁর পরিবার। আফগানিস্তানে ন্যাটোর হয়ে কাবুল বিমানবন্দরে কাজ করতেন তিনি। প্রায় ১৮ বছর ধরে ওই পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। আফগানিস্তানে নিজের বাড়ি, নিজের গাড়ি, যথেষ্ট উপার্জন, দিব্যি স্বাচ্ছন্দ্যেই সেখানে ছিলেন আজমল। তার পরেই তালিবান ঢুকে পড়ল দেশটায়। বারবার হুমকি আসছিল। যুদ্ধের আঁচ পেয়ে তাই ঘরবাড়ি বেচে পরিবার নিয়ে পালিয়ে এলেন আজমলরা। ইউক্রেনই সে সময় ছিল একমাত্র দেশ, যারা আজমলকে ভিসা দিতে রাজি হয়েছিল। ওডেসায় এসে ঘর বাঁধলেন তারা। এই দেশটায় এসে ভেবেছিলেন, এ জীবনে বেঁচে গেলেন বোধহয় তাঁরা। ইউক্রেনটাকে সে সময় স্বর্গ বলেই মনে হয়েছিল আজমলদের।
তবে সেই সুখ বোধহয় বেশিদিন সইল না কপালে। যে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে ইউক্রেনে পালিয়ে এসেছিলেন, সেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল স্বর্গের মতো সুন্দর দেশটাতেও। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান ঘোষণা করে দিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। তার পর থেকে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে ইউক্রেন জুড়ে। শহরের রাস্তায় টহল দিচ্ছে রুশ বাহিনী। ফের সেই আতঙ্কের দিন যেন ফিরে এল আজমলদের জীবনে।
আরও শুনুন: ‘ভয় করছে’, মাকে শেষ মেসেজে জানিয়েছিলেন নিহত রুশ সেনা
৬ দিনে পড়ল ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছেন হাজার হাজার বাসিন্দা। পোল্যান্ড, হাঙ্গারি থেকে রোমানিয়া, যে যেখানে পারছেন, পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন। ব্রিটেনের একটি শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছেন এর মধ্যেই। তার মধ্যে তিরিশ হাজার মানুষই আশ্রয় নিয়েছেন পোল্যান্ডে। ইতিমধ্যেই মানুষের বিস্ফোরণ শুরু হয়েছে পোল্যান্ডের সীমান্তে। অসংখ্য মানুষ এসে আশ্রয় খুঁজছেন সেখানে। যেমন এসেছেন আজমলরা। ১১ বছরের ছেলে ওমর, ৭ বছরের মেয়ে মারোয়া ও স্ত্রী মীরার হাত ধরে প্রায় ১৮ মাইল রাস্তা হেঁটে পার হতে হয়েছে তাঁকে। পোল্যান্ডের মেদিকা গ্রামে পৌঁছে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে তাঁদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রজেমিসল শহরে।
যে যুদ্ধ, যে রক্তারক্তির ভয়ে একদিন ঘরবাড়ি, সুখের জীবন ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন, সেই দুঃস্বপ্নের দিন যেন আবার ফিরে এল জীবনে। আবার পালানো, আবার সব কিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসা- এক জীবনে আর কতবার। বারবার নিজের দুর্ভাগ্যকেই দুষছেন আজমল। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ, এই জীবন সবটাকেই এখন খুব অনিশ্চিৎ বলে মনে হয় তাঁর। তবু দিনের শেষে পরিবার, জীবনের চেয়ে বড় কোনও কিছুই নয়। সেই শান্তির আশাতেই ফের বুক বাঁধছেন ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা অসংখ্য আজমলেরা।