নির্বাচন কমিশন যতই বিভাজন থামাতে বলুক, তাতে আদৌ কান দেয়নি বিজেপি। কেবল গত দু’সপ্তাহের নির্বাচনী প্রচারেই ৪২১ বার বিভাজনের কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদি। হিসেব দিয়ে জানালেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। শুনে নেওয়া যাক।
এবারের মতন নির্বাচনী প্রচার শেষ। প্রচার শেষ করে ধ্যানে ডুব দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু তার আগে, গোটা প্রচার পর্বে তিনি ঋষিসুলভ সংযম দেখিয়েছেন কি? সে কথায় ঘোরতর আপত্তিই জানাবে কংগ্রেস। বরং প্রচার জুড়ে প্রয়োজনমতো বিভাজন মন্তব্য আর ঘৃণাভাষণই ছুড়ে গিয়েছেন মোদি, এমনটাই বলছে হাত শিবির। রীতিমতো হিসেবনিকেশ করেই কংগ্রেস সভাপতি খাড়গে জানাচ্ছেন, নির্বাচনী প্রচারে অন্তত ৪২১ বার বিভাজনের কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচন কমিশন যতই জাতপাত ইস্যুতে ভোটভাগের বিরোধিতা করুক, কমিশনের নির্দেশিকার তোয়াক্কা না করেই কার্যত চড়েছে বিভাজনের সুর।
আরও শুনুন:
ধ্যান-জ্ঞান বঙ্গের ভোট! তাই কি বিবেকানন্দ রকেই চলবে ‘মোদি-মেডিটেশন’?
ভোটের প্রথম দু’দফা মিটতেই বিভাজনের রাজনীতিতে শান দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল মোদির বিরুদ্ধে। কংগ্রেসের ইস্তাহারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে মোদি বলেছিলেন, মানুষের কষ্ট করে উপার্জন করা সোনাদানা কংগ্রেস বিলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। কাদের মধ্যে? না, যাঁরা অনুপ্রবেশকারী, আর যাঁদের বেশিসংখ্যক সন্তান আছে তাঁদের মধ্যে। এই বক্তব্যের পরই চলতি রাজনীতি পেয়ে যায় মঙ্গলসূত্র-বিতর্ক। বিরোধীরা তো বটেই, বহু মানুষ মনে করতে শুরু করেন যে, মোদির মূল আক্রমণের লক্ষ্য ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা, বিশেষত মুসলিমরা। এখানেই শেষ নয়। কখনও শ্রাবণ মাস কি নবরাত্রিতে মাছ-মাংস খাওয়া নিয়ে রাহুল-তেজস্বীকে বলেছেন মুঘল মানসিকতার প্রকাশ, কখনও কংগ্রেসের ইস্তেহারে ‘মুসলিম লিগের মনোভাব’ প্রকাশ পাচ্ছে বলে কটাক্ষ করেছেন মোদি। প্রথমদিকে তাঁর বক্তব্যে ধর্মীয় রং তুলনায় কম থাকলেও, ভোটের দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁজালো হয়েছে বিভাজনমূলক বক্তব্যের সুর। মাছ, মঙ্গলসূত্র থেকে মন্দির, মসজিদ, এমন সব বিভাজনমূলক শব্দই জাঁকিয়ে বসেছে মোদির বক্তব্যে। প্রথম দু’দফার পরেই লালু প্রসাদ যাদব হিসেব দিয়ে বলেছিলেন, প্রথম দু’দফায় নির্বাচনী প্রচারে হিন্দি ভাষায় দেড় লক্ষ শব্দ খরচ করেছেন মোদি। আর সব বিষয়ের টেকনিক্যাল তত্ত্ব-তথ্য ধরে মোট শব্দ খরচের সংখ্যা ঠেকছে মোটামুটি সাড়ে ৬ লক্ষে। কিন্তু এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় শব্দ কী কী? লালু তালিকা দিয়েছিলেন, পাকিস্তান, হিন্দু-মুসলিম, মন্দির-মসজিদ, মাছ-মুঘল, মঙ্গলসূত্র, গরু-মোষ, শ্মশান ও কবর- এই আট শব্দই মোদির সবচেয়ে প্রিয়। অথচ চাকরি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, উন্নতির মতো শব্দ নিয়ে তাঁর মুখে উচ্চবাচ্য নেই।
আরও শুনুন:
গান্ধীদের সঙ্গে কি শুধুই শত্রুতা! নাকি ফোনে কথা-টথাও হয়? খোলসা করলেন মোদি
এই ইস্যুতেই সম্প্রতি মুখ খুলেছেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তাঁর পুরনো বক্তব্যকে বিকৃত করেই মঙ্গলসূত্র বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন মোদি। এবার খোলা চিঠিতে মনমোহন সিং সাফ বলেছেন, নরেন্দ্র মোদির মতো এত বেশি ঘৃণাভাষণ আর কোনও প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোনা যায়নি। আর এবার খাড়গেরও বক্তব্য, শেষ দু’সপ্তাহে ২৩২ বার কংগ্রেসের নাম নিয়েছেন মোদি। ‘ইন্ডিয়া’, যাকে তিনি ইন্ডি জোট বলেই বিদ্রুপ করেন, তার নাম এসেছে ৫৭৩ বার। ৭৫৮ বার আওড়েছেন নিজেরই নাম। অথচ বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির মতো জ্বলন্ত সমস্যার কথা উচ্চারণও করেননি। কমিশনের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, জাতপাত বা সাম্প্রদায়িক ভাষণ দেওয়া যাবে না। অথচ মন্দির, মসজিদ, মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্ম নিয়ে ৪২১ বার কথা বলেছেন মোদি। মুসলমান, পাকিস্তান, সংখ্যালঘু এই শব্দগুলি উচ্চারণ করেছেন ২২৪ বার। প্রচারের শেষ ক’দিনে তুরুপের তাস হিসেবেই যে বিভাজন অস্ত্রে শান দিয়েছেন মোদি, সেদিকেই ইঙ্গিত কংগ্রেসের। প্রথমদিকে যে চেনা অস্ত্রটি তুলে রেখেছিলেন, পরে তাকেই লাগাতার ব্যবহার করতে দেখেই জোটের জল্পনা, তবে কি বিজেপি শিবিরেও খানিক আশঙ্কার হাওয়া লেগেছে? যে আত্মবিশ্বাসে ভর করে ৪০০ পারের সুর বেঁধেছিলেন মোদি-শাহেরা, সেই বিশ্বাসই কি ভোটের হাওয়ায় টলে গিয়েছে? বিশেষ করে মোদির বিভাজন মন্তব্যের সংখ্যা যেভাবে আসনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেল, তাতে আশাতেই বুক বাঁধছেন খাড়গেরা।