ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র মাস রমজান। নিষ্ঠাভরে মহরম পালিত হয় এই মাসেই। ভারতবর্ষে এ খুব চেনা দৃশ্য। কিন্তু যদি শোনা যায়, যে, যে গ্রামে মহরম পালিত হচ্ছে, সেখানে একজনও মুসলিম বাসিন্দা নেই, তবে কি অবাক হবেন? অবাক হওয়ার মতোই কথা বটে! তবে, এমন গ্রামের হদিশ আছে এই ভারবর্ষেই। আসুন শুনে নেওয়া যাক সেই গ্রামের কথা।
গোটা গ্রাম সেজে উঠেছে আলোর মালায়। রঙিন কাগজে ঝলমল করছে এদিক ওদিক। চারিদিকে চোখ মেললেই বোঝা যায়, গ্রাম জুড়ে চলছে মহরমের প্রস্তুতি। ইসলামিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পবিত্র রমজান মাস আসা মানেই গ্রামের মানুষের মধ্যে অন্যরকম উদ্দীপনা। বিষাদসিন্ধুর উদযাপনের জন্য তৈরি সকলে। অথচ আশ্চর্য এই যে, গোটা গ্রামে একজনও মুসলমান বাসিন্দা নেই। আজকের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বাতাবরণে মনে হতে পারে, এ যেন কোনও অলীকপুর। কিন্তু না, এই ছবি ঘোর বাস্তব। আর এ গ্রামের খোঁজ মেলে আমাদের দেশেই। বলা যায়, কর্ণাটকের এই হিরেবিদানুর গ্রামখানা যেন ব্যতিক্রমী হয়েই সাক্ষ্য দিচ্ছে দেশের উদার ধর্মীয় সংস্কৃতির।
আরও শুনুন: বর্ষা নামলেই মাটি থেকে মেলে হিরে, কোথায় রয়েছে এমন রূপকথার রাজ্য?
তবে এই গ্রামের মহরম পালনে ঐতিহ্যে খানিকটা আশ্চর্য হতে হয় বইকি! সম্প্রীতির প্রশ্নেও এরকম নমুনা সচরাচর দেখা যায় না। নানা ধর্ম, নানা মতের সহাবস্থান আমাদের দেশের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। তবে কোনও ধর্মীয় উৎসব সাধারণত নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীরাই পালন করে থাকেন। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের আপত্তি থাকার কথা নয়। কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে ভিন সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণও করে থাকেন। কিন্তু যেখানে একজনও মুসলমান বাসিন্দা নেই, সেখানে সমারোহে মহরম পালনের প্রথা এলই বা কোথা থেকে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে গ্রামটির ইতিহাসে। আজ সেখানে একজন মুসলিম বাসিন্দা নেই ঠিকই, কিন্তু এককালে ছিল। দুই ভাইয়ের কথা জানা যায়, যাঁরা ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাঁরা একটি মসজিদও নির্মাণও করেছিলেন। সেই দুই প্রাচীন বাসিন্দার মৃত্যুর পর ক্রমে তাঁদের পরিবারের চিহ্ন হারিয়ে গিয়েছে গ্রাম থেকে। থেকে গিয়েছে ওই মসজিদটি। আর যে প্রথা তাঁরা চালু করেছিলেন, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। গ্রামবাসীদেরমধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে থেকে গিয়েছে সেই রেশ। বর্তমানে কোনও মুসলিম বাসিন্দা না থাকলেও তাই গ্রামবাসীরা মহরম পালন করে থাকেন একান্ত আগ্রহেই।
আরও শুনুন: গাঁটের কড়ি খরচ করেও স্বাদ মিলছে না, ইলিশ রান্নাতেই গড়বড় করছেন না তো?
শুধু এই বৈশিষ্ট্যেই নয়, আরও অনেক ভাবেই চমকে দেয় কর্ণাটকের এই হিরেবিদানুর গ্রাম। বর্তমানে সেখানকার মসজিদটির দেখভাল করেন একজন হিন্দু পুরোহিত। তিনিই সেখানে প্রার্থনার আয়োজন করেন নিয়মিত। তবে মহরমের মতো উৎসব পালনের ক্ষেত্রে অন্যরকম প্রয়াস দেখা যায়। পাশের কোনও মসজিদ থেকে একজন মৌলবিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মহরমের সময় তিনি এসে বসবাস করেন এই গ্রামে। এবং মহরমের যাবতীয় আয়োজন করেন নিজের হাতে। এই মৌলবির দেখভালের দায়িত্ব নেন স্থানীয় গ্রামবাসীরাই। মূলত কুরুবা ও বাল্মিকী গোত্রের বাসিন্দারাই এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ধর্ম কোনও ভাবেই এই প্রথা পালনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
সম্প্রতি ধর্মীয় কারণে অসহিষ্ণুতার যেন বাড়বাড়ন্ত। নানা অপ্রীতিকর ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। এই কর্ণাটকও তার ব্যতিক্রম নয়। সম্প্রদায়গত বিভাজনের বহু খবর শিরোনামে উঠে আসে। তবে ব্যতিক্রমেরও ব্যতিক্রম থাকে। এই গ্রামের বাসিন্দারা যেভাবে একটি প্রথাকে ধর্মীয় মোড়কের বাইরে গিয়ে সাদরে অন্তরে গ্রহণ করেছেন, তার তুলনা সহজে মেলে না। আর এ ছবি আমাদের দেশেরই। ধর্ম নিয়ে উন্মাদনার ঝোড়ো বাতাসের মধ্যেও গ্রহিষ্ণুতার এই দৃশ্যটুকু তাই আমাদের ভরসাই জোগায়।