সরকারের কাজের বিরোধিতা করে অনেকসময়ই সরকারি সম্মান ফিরিয়ে দেন বিদ্বজ্জনেরা। কিন্তু আর বোধহয় করা যাবে না তেমনটা। ‘অ্যাওয়ার্ড ওয়াপসি’ রোখার জন্য নয়া নীতি আনার কথা ভাবছে কেন্দ্র। কোনও পরিস্থিতিতেই পুরস্কার ফেরাবেন না, পুরস্কার গ্রহণের আগে এই মর্মে মুচলেকা লিখতে হবে বলে দাবি কেন্দ্রের। কিন্তু এভাবে শর্তসাপেক্ষে কি পুরস্কার গ্রহণ করবেন বিদ্বজ্জনেরা? সে উত্তর দেবে সময়ই।
ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে নাইটহুড উপাধি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে সম্মান গ্রহণও করেছিলেন তিনি। কিন্তু বছর কয়েক পরেই জালিয়ানওয়ালাবাগের চত্বরে ঘটল নৃশংস গণহত্যার ঘটনা। ব্রিটিশদের নির্বিচারে গুলিতে নিহত হলেন দেশের বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ। ঘটনায় স্তম্ভিত কবি ডাক দিলেন প্রতিবাদের। কিন্তু সমসময়ের অনেক নামী মানুষই তখনও ভেবে উঠতে পারছেন না এরপরে কী করা উচিত। সেই পরিস্থিতিতে আর কারও জন্য অপেক্ষা করলেন না রবীন্দ্রনাথ। যত ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন, তিনিই তো বলেছেন একলা চলার কথা। ব্রিটিশরাজকে চিঠি লিখে তিনি জানিয়ে দিলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিবাদে নাইটহুড ত্যাগ করছেন তিনি।
আরও শুনুন: নতুন যুগের রানার তাঁরা, শ্রমিকের সুবিধা কি আদৌ পাবেন?
প্রতিবাদ যে এমনও হতে পারে, তার পথ দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনিই বলেছিলেন, রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান। কিন্তু রাজনীতি জানে, সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থ নানারকম হতে পারে। রাজা যদি বড় কোনও অসম্মানের ঘটনা ঘটান, তাহলে নিজের পাওয়া সম্মান রাজাকেই ফিরিয়ে দিয়ে একরকম প্রতিবাদ জানাতে পারেন কোনও মানী ব্যক্তি। যেমনটা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর বিভিন্ন সময়ে সে পথে হেঁটেছেন দেশের অনেক বিদ্বজ্জনই। যাঁরা একসময় পুরস্কার পেয়েছিলেন সরকারের থেকে, কিন্তু বর্তমানে সেই সরকারেরই এক বা একাধিক আচরণ দেখে ক্ষুব্ধ তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে সেই সরকারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতেই অস্বস্তিতে পড়ছেন ওই পুরস্কার প্রাপকেরা। আর তাই সিদ্ধান্ত ওই পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার। বিশেষ করে মোদি জমানায় এমনটা ব্যতিক্রম নয় একেবারেই। একের পর এক উদারবাদী বিশিষ্ট লেখককে হত্যার পরেও যখন সাহিত্য অকাদেমি সেই হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনও অবস্থান নেয়নি, সেই সময়ে অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেন ২৬ জন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। সরকারের দেওয়া সম্মান সরকারের কাছে ফেরত আসছে, এ ঘটনা সরকারের কাছে যে সপাট আঘাত, তা বলাই যায়। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটার নেপথ্যে কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, আর সেই পরিস্থিতি তৈরির পিছনে সরকারের ভূমিকা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি বর্তমান কেন্দ্র সরকার। ‘অ্যাওয়ার্ড ওয়াপসি’ বন্ধ করার জন্য বরং উলটো পথেই হাঁটতে চায় কেন্দ্র। সরকার এমন একটি আইন চালু করতে চায়, যাতে পুরস্কার গ্রহণের আগেই মুচলেকা লিখতে হবে প্রাপকদের। এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে তাঁদের, যে, কোনও অবস্থাতেই তাঁরা এই পুরস্কার ফিরিয়ে দেবেন না। সরকারের মতে, কোনও প্রাপক পরে পুরস্কার ফিরিয়ে দিলে তাতে অন্য প্রাপকদের অসম্মান, দেশের ভাবমূর্তিরও ক্ষতি। আর তাই এবার শর্তসাপেক্ষে পুরস্কার দেওয়ার ভাবনা তাঁদের।
আরও শুনুন: ৫ বছরে আত্মহত্যা ৯৮ পড়ুয়ার! উদ্বেগ বাড়াচ্ছে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিস্থিতি
কিন্তু সম্মান যাঁকে দেওয়া হয়, আসলে তো তা কোনও পারিশ্রমিক বা পারিতোষিক নয়। লেখক বা শিল্পীকে সম্মান জানিয়ে আসলে কোনও রাষ্ট্র বা কোনও সংস্থা নিজে সম্মানিত হতে চায়। গণতন্ত্রের পরিসরে এই সম্মানের সঙ্গে তাই কোনোরকম শর্ত জুড়ে থাকতে পারে না কখনোই। বিশেষ করে যিনি শিল্পী, তাঁর পক্ষেও মানুষের অধিকারকে সম্মান জানানোই সবচেয়ে সঙ্গত কাজ। মানবতার অপমানে তিনি যে ফুঁসে উঠবেন, এমনটাই প্রত্যাশিত। কোনও সরকার সেই অবদমনের ঘটনা ঘটালে তা মুখ বুজে মেনে নেওয়াও তো শিল্পীর ধর্ম হতে পারে না। সরকারের সম্মান নিতে গেলে সরকারের প্রতিটি কাজে সায় দিতেই হবে, এ কথা শিল্পীর সম্মানের বিরোধী, গণতন্ত্রেরও বিরোধী। যদিও এই কথাগুলি যে আদৌ ভেবে দেখতে চাইছে না কেন্দ্র সরকার, আইন আনার ভাবনাচিন্তা করে সে কথাই বুঝিয়ে দিয়েছে তারা। কিন্তু নিজেদের সম্মান বিসর্জন দিয়েই কি সরকারের হাত থেকে প্রতীকী সম্মান নিতে চাইবেন এ সময়ের বিদ্বজ্জনেরা? সে উত্তর হয়তো দেবে সময়ই।