সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলিতে বেনিয়মের অভিযোগ কিন্তু নতুন নয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষার পথে ভিড় কম, তাই এ খবর ছড়ায়ও কম। টেট দুর্নীতির কথা যত সহজে প্রকাশ্যে এসেছে, কলেজের অধ্যাপনা সংক্রান্ত বেনিয়মের কথা ততখানি সামনে আসে না একই কারণে। এ বেনিয়ম কিন্তু কেবল প্রশ্ন ফাঁস বা টাকার বিনিময়ে আসন কেনায় নয়। প্রশ্নের ধরন, বা বলা ভালো পরীক্ষার ধরনটিও কতখানি ছাত্রবান্ধব, তা নিয়েও তো বিতর্ক রয়েছে। কয়েক ঘণ্টার এই টিক মারার পরীক্ষাগুলি কি আদৌ তার অভীষ্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে। ছোটবেলা থেকে এই মন্ত্র শুনতে শুনতে মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। জানা হয়েছিল, যাবতীয় দুঃখ আর না-পাওয়া মুছে দিতে পারে একটাই জাদুলাঠি। সে মিকি মাউস আঁকা টিফিনবক্স থেকে টিনটিনের বই কেনাই হোক, কি ইচ্ছে হলে রেস্তরাঁয় খাওয়া বা ঘুরতে যাওয়া, এই গোটা আলিবাবার রত্নভাণ্ডার চিচিং ফাঁক হয়ে যেতে পারে কেবল একটাই মন্ত্রে, তার নাম লেখাপড়া। বড় হতে হতে অবশ্য সে মায়াকাজল খানিক ফিকে হয়ে আসে। বোঝা যায়, সব পেয়েছির দেশটা ঠিক অতটাও কাছে নয়। আর সেখানে পৌঁছনোর পথে মাথা উঁচিয়ে আছে হাজারও বাধাবিপত্তি। তবুও, লক্ষ্য টলে না। উচ্চশিক্ষার একটা ধাপ পেরোতে পেরোতে পাখির চোখ আটকে থাকে পরের সিঁড়িতে, মনে হয় এমন করেই একদিন পৌঁছে যাওয়া যাবে প্রার্থিত লক্ষ্যে। যারা নিট দিয়েছিল কিংবা নেট, সন্দেহ নেই, তারাও কমবেশি এমনটাই ভেবেছিল।
আরও শুনুন:
বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে! রেলের পুরনো আমলেও কি এ কথাই ভেবেছিল ভারত?
ভেবে দেখুন, কম্পিউটার গেমগুলোও অনেকটা এমনই হয় না কি? একটা লেভেল জেতার পথে বাধা কম থাকে না। সব বাধা কাটিয়ে একটা স্তর শেষ করতে পারলে তবেই মেলে পরের পর্যায়ে ঢুকতে পারার ছাড়পত্র। উচ্চশিক্ষাও যেন সেই নিয়ম মেনেই চলে। কিন্তু সেই নিয়ম, থুড়ি বেনিয়মের দায়ে সেখানেও এখন খেলাই হচ্ছে বটে।
প্রথম খেলা হয়েছিল টেট-এ। তা অবশ্য উচ্চশিক্ষার সোপান নয় ঠিক, তবে উচ্চশিক্ষার দরুন যে চাকরি পাওয়া যায়, সাধারণ ঘরের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েকে সে ভরসা জুগিয়েছিল টেট। প্রাথমিক থেকে উচ্চপ্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক, একাধিক স্তরে শিক্ষকের চাকরির পথ খোলা ছিল। সরকারি চাকরির নিশ্চিত আশ্রয় বেছে নেওয়ার জন্য আদাজল খেয়ে প্রস্তুতি নিতেন বাংলার যুবকযুবতিরা। তারপর একসময় সে চাকরির পরীক্ষায় এল দীর্ঘসূত্রিতা। বছরের পর বছর গড়াতেই থাকল, অথচ নিয়োগের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। আদালতে জমছিল মামলা। একসময় ফাঁস হয়ে গেল, লাগাতার পড়াশোনা করে যে চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন পড়ুয়ারা, সেসব চাকরি কবেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে মোটা টাকার বিনিময়ে।
সম্প্রতি আরও বড় খেলা হয়ে দেখা দিল নিট। ডাক্তারির পাঠক্রমে ভর্তি হতে গেলে যে সাড়ে তিন ঘণ্টার সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসতে হয়, তার নাম ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট, সংক্ষেপে ‘নিট’। এমনিতেই ভালো ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি পড়বে, মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের পর ‘কী হবে’-র উত্তরে সেই অলিখিত নিয়ম চোখে পড়ে। তার উপরে ডাক্তার হলে আছে বিপুল আয়ের প্রলোভন। যে পাঠক্রম মুখ্যত টাকা রোজগারের রাস্তা, তাতে জায়গা পেতে গেলে ভারতের মতো দেশে টাকার খেলা থাকবে না, তা কি হয়? চিকিৎসা ও শিক্ষা, দুই-ই বর্তমানে বড় পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র। আর এবার দেখা গেল, নিট-এর মতোই নেট-এও প্রশ্ন ফাঁসের খেলা। ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট নামের যে সর্বভারতীয় পরীক্ষা গোটা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণা করার সুযোগ দেয়, উপরন্তু অধ্যাপনার প্রাথমিক দরজা খুলে দেয়, সেই পরীক্ষা হওয়ার পরদিনই জানা গেল, পরীক্ষা বাতিল। এখানেও আগেভাগেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গিয়েছে বলে উঠছে অভিযোগ।
আরও শুনুন:
পর্ন ছাড়লেও পর্নস্টার! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সানির শো বাতিলে উঠছে প্রশ্ন
কথা হল, এই সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলিতে বেনিয়মের অভিযোগ কিন্তু নতুন নয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষার পথে ভিড় কম, তাই এ খবর ছড়ায়ও কম। টেট দুর্নীতির কথা যত সহজে প্রকাশ্যে এসেছে, কলেজের অধ্যাপনা সংক্রান্ত বেনিয়মের কথা ততখানি সামনে আসে না একই কারণে। এ বেনিয়ম কিন্তু কেবল প্রশ্ন ফাঁস বা টাকার বিনিময়ে আসন কেনায় নয়। প্রশ্নের ধরন, বা বলা ভালো পরীক্ষার ধরনটিও কতখানি ছাত্রবান্ধব, তা নিয়েও তো বিতর্ক রয়েছে। কয়েক ঘণ্টার এই টিক মারার পরীক্ষাগুলি কি আদৌ তার অভীষ্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? যেখানে উচ্চশিক্ষার জন্য পড়ুয়াদের নির্বাচনের কথা হচ্ছে, সেখানে তাদের মেধা, পড়ার প্রতি ইচ্ছা ও ভালোবাসা, জ্ঞানের গভীরতা, সবই বিচার্য। কে ধীমান আর কে কম মেধাবী, তা কি অঙ্কের নিয়মে কেবল এমসিকিউ-র মাধ্যমে বিচার করা যায়? কৌশল এবং চকিতে অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পটুত্বই এই পরীক্ষায় সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিচ্ছে, মূল বিষয় ভাল করে বোঝার প্রয়োজনই নেই। স্রেফ কিছু তথ্য মুখস্থ করে তা উগরে দিলেও যে পরীক্ষায় পাশ করে ফেলা সম্ভব, এবং ওই মুখস্থবিদ্যা না থাকার দরুনই কোনও মেধাবী পড়ুয়াও যে সেখানে পিছিয়ে যেতে পারে, এই পরীক্ষাগুলি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। তার উপরে নেট-এর প্রশ্ন দেখলে মনে হওয়া অসম্ভব নয় যে, এখানে মুখস্থবিদ্যার সঙ্গে কপালজোরও দরকার। বিশেষ করে সাহিত্যের বিষয়গুলি, তথ্য মুখস্থ করা দিয়ে যেখানে সাহিত্যবোধের আঁচ পাওয়া সম্ভবই নয়, সেখানেও নেটের প্রশ্নের ধরন কী? প্রশ্ন আসে বিভিন্ন উপন্যাসের বাক্যসজ্জা সাজাতে দিয়ে, প্রশ্ন করা হয় কোনও বইয়ের দাম কত ছিল, কোথায় কে কী রঙের পোশাক পরেছে কিংবা তার হাতের ঘড়িতে আসলে কটা বাজছিল, এমনই।
বারেবারে এহেন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতে অনেকেই হাল ছাড়েন। সযত্নে লালিত গবেষণার স্বপ্ন, অধ্যাপনার আশা ছেড়ে অন্য কোনও পেশার পথে পা বাড়ান। একসময় পড়াশোনাকেই যেখানে লক্ষ্য করে তোলা হত, এখন সচেতন পড়ুয়ারা অনেকেই সে পথে হাঁটতে চান না। তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষীরাও সতর্ক করে দেন আগেভাগেই। উলটোদিকে গবেষণা হিসেবে সামনে আসতে থাকে এমন অনেক থিসিস, যার না আছে মৌলিকত্ব, না গভীরতা। এসবের দরুন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিক্ষাজগতেরই। শিক্ষার দুনিয়ায় সমানাধিকার অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা করতে গিয়ে শিক্ষার মানকেই নামিয়ে আনা কোনও কাজের কথা নয়। মেধাবী, যোগ্য এবং কৌতূহলী উত্তর প্রজন্ম তৈরি করা না গেলে আদতে তা গণতন্ত্রেরও সংকট ডেকে আনে। তা নিয়ে রাষ্ট্রের মাথাব্যথা যদি না-ই থাকে, তবে এ দেশের উচ্চশিক্ষারও বাস্তবেই ‘খেলা’-য় পরিণত হতে আর দেরি থাকবে না।