কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ছিটকে যাওয়া বগি, একের পর এক মৃত মুখ প্রশ্ন ছুড়ছে, আর কতদিন মানুষের প্রাণ নিয়ে এমন খেলা হবে? রেল দুর্ঘটনায় দাঁড়ি পড়বে কবে? এদিকে তথ্য বলছে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও ২২৭ বছর! ব্যাপারটা ঠিক কী? শুনে নেওয়া যাক।
ভারতীয় রেল যে তার যাত্রীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ, একের পর এক দুর্ঘটনা সে কথাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। তথ্য বলছে, সুরক্ষাজনিত যা কিছু তার পরিকল্পনা, তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত করতেও সে সফল হয়নি। আবার প্রয়োজনমাফিক কর্মীর জোগান দিতেও সে নেহাতই অক্ষম। তবে একটি ব্যাপারে ভারতীয় রেল ধারাবাহিকভাবে সফল। তা হল, দেরি করায়। দেরি করা নিয়ে ভারতীয়দের এমনিতেই বিশেষ সুনাম নেই। ভোট দেওয়ার অধিকার মিলতে তার দেরি হতে পারে, তবে লেট করা তার জন্মগত অধিকার। আর সেই অধিকারের ম্যাসকট হওয়ার দাবি অনায়াসেই করতে পারে ভারতীয় রেল। নিজেদের ম্যাসকট হাতির মতোই গজগমনে চলতে সে ভালোইবাসে। না না, বন্দে ভারত কি বুলেট ট্রেনের কথা হচ্ছে না। যেখানে অনেক টাকা দিয়ে অনেক সুবিধা আর স্বাচ্ছন্দ্য কিনে নেওয়া হয়েছে, সেখানে দেরি কিংবা দুর্ঘটনা, কোনও কিছুই তো থাকার কথা নয়। সেই সুবিধাকে সুপারফাস্ট গতিতে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বরং দেরি করানো যেতে পারে সাধারণ ট্রেনগুলিকে, যেখানে চড়েন সাধারণ পকেটের সাধারণ মানুষেরা। কেবল পথে দেরি করিয়ে দেওয়া নয়, দেরি হতে পারে সাধারণ ট্রেনের একান্ত প্রয়োজনীয় সুরক্ষার সুবিধা দিতেও। তাতে অবশ্য সেইসব মানুষদের অনেকেরই মৃত্যুর পথে দেরি হয় না। হিসেবের অনেকটা আগেই আচমকা জীবন ফুরিয়ে যায় তাঁদের। যেমনটা ঘটল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায়। মাত্র ছ’বছরের শিশুর আর অধিকার রইল না এ পৃথিবীতে, স্ত্রীর সঙ্গে আগের রাতে গানের আসর বসানোর পর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ‘নেই’ হয়ে গেলেন তাঁর স্বামী, কিংবা চাকরিতে যোগ দিতে আসার পথেই ডিউটিতে দাঁড়ি পড়ল যুবকের। তবে এ তো নতুন কথা নয়। হিসেব বলছে, শুধু ২০২৩ সালেই সাড়ে তিনশোর বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন রেল দুর্ঘটনায়। আর এই দুর্ঘটনার ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। কিন্তু তারপরেও কি রেল কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারের কাজের গতি বেড়েছে? যাতে রেলকে দুর্ঘটনা মুক্ত করা যায়, সেই পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছে অবিলম্বে?
আরও শুনুন: কাঞ্চনজঙ্ঘা বেলাইন হতেই প্রশ্নের মুখে ‘মিশন জিরো অ্যাক্সিডেন্ট’, আসলে কী ছিল ওই ‘মিশন’?
উঁহু, সেই পদক্ষেপের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দেরি। এমনিতে ২০১৬-১৭ সালে কেন্দ্রীয় রেল মন্ত্রক শপথ নিয়েছিল, দুর্ঘটনা কমিয়ে শূন্যে আনা হবে। সেই সুরক্ষার শপথের নাম দেওয়া হয় ‘মিশন জিরো অ্যাক্সিডেন্ট’। এই মিশনে রেল জানিয়েছিল, নিয়মিত রেল লাইন রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হবে। দুর্ঘটনা রুখতে সক্ষম লিঙ্ক হফম্যান বুশ অর্থাৎ এলএইচবি রেল বগি ও আধুনিক ইঞ্জিন ব্যবহার করা হবে। যাতে দুই ট্রেনের ধাক্কা লাগলে একটি কামরা আর একটি কামরায় ঢুকে যাবে না, দেশলাইবাক্সের মতো লাইন ছেড়ে উলটেপালটে যাবে না। আধুনিক করা হবে সিগন্যালিং সিস্টেমও। একই লাইনে দু’টি ট্রেন চললেও যাতে দুর্ঘটনা এড়ানো যায়, সেজন্য লাইনে ‘Automatic Train Protection’ প্রযুক্তি ‘কবচ’ ব্যবহারের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। যদিও কাঞ্চনজঙ্ঘা দুর্ঘটনার পর জানা যাচ্ছে, সেখানে না ছিল এলএইচবি বগি, না ছিল কবচ, এমনকি স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং সিস্টেমও খারাপ ছিল। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যানের দাবি, আগামী বছরের মধ্যে ৬০০০ কিলোমিটার লাইনে কবচ ব্যবস্থা মোতায়েনের কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে রেলের। অথচ, রেল যে গতিতে কাজ করছে, তা হিসেব করলে দেখা যাবে, গোটা দেশের সব লাইনে এই সুরক্ষা কার্যকর হতে সময় লেগে যাবে ২২৭ বছর।
এর আগে রাজ্যসভায় এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো জানিয়েছিলেন, ২০১৮-১৯ সালের মধ্যে ২৫০ কিলোমিটার লাইনে কবচ বসেছিল। ২০১৯-২০ সালে কাজ হয় ১৫ কিলোমিটার রেললাইনে। ২০২০-২১ সালে ৩২১ কিলোমিটার আর ২০২১-২২ এ ৮৫৯ কিলোমিটার জুড়ে কাজ চলার পর, ২০২২-২৩ সালে কাজ হয়েছে মাত্র ২০ কিলোমিটার। অর্থাৎ ২০১৮ থেকে ২০২৩, এই সময়ে সুরক্ষার কাজ এগিয়েছে ১৪৬৫ কিলোমিটার। যেখানে ভারতীয় রেলওয়ে বিছানো রয়েছে মোট ৬৮ হাজার কিলোমিটার পথে। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৬৬ হাজার কিলোমিটার পথে কাজ বাকি। এখনও পর্যন্ত হওয়া কাজের বার্ষিক গড় হিসেব করলে সেই পুরো পথের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২২৭ বছর। এর আগেও জানা গিয়েছিল, রেলওয়ের মোটামুটি ৮৪০টি প্রোজেক্ট আপাতত লেটে রান করছে। তাও এক-দুদিন নয়, প্রকল্প শেষ হতে গড়ে ৩৬ মাস করে দেরি হবে বলে আন্দাজ কর্তৃপক্ষের। এবার জানা যাচ্ছে, রেললাইন পাতা হোক কি সেই লাইনে সুরক্ষাকবচ বসানোই হোক, দেরি করাই ভারতীয় রেলের স্বভাব। তবে তার স্বভাব মেনে নিয়ে দুর্ঘটনারা দেরি করবে কি না, সে প্রশ্ন বোধহয় না করাই ভালো। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া দুটি বগি থেকেই তো তার উত্তর মিলে গিয়েছে।