বিবাহবিচ্ছেদের পর খোরপোশ দাবি করতে পারেন মুসলিম মহিলারাও। এমনকি সে বিচ্ছেদ তিন তালাকে হলেও। সম্প্রতি এমনই রায় শুনিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আর তাতে মুসলিম নারীদের অধিকারের জমিটি আরও একটু শক্ত হল বলেই মনে করা যায়। এহেন মনে হওয়ার যুক্তি কী? শুনে নেওয়া যাক সে কথাই।
তিন তালাক নিষিদ্ধ হয়েছিল আগেই। এবার সুপ্রিম কোর্ট জানাল, তিন তালাক প্রথার মাধ্যমেও যদি কোনও মুসলিম মহিলার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে থাকে, তাহলেও খোরপোশ পাবেন তিনি। দেশের শীর্ষ আদালত স্পষ্ট করে দিয়েছে, খোরপোশ পাওয়া যে কোনও বিবাহিত মহিলারই অধিকার, আর সেই অধিকারে হিন্দু মহিলাদের মতোই শামিল মুসলিম মহিলারাও। এমনিতেই শরিয়ত আইনের আলাদা প্রয়োগের কারণে মুসলিম মহিলাদের বিয়ে সংক্রান্ত আইন বেশ জটিল ছিল। আরও ধোঁয়াশা ছিল তাঁদের অধিকারের প্রশ্নে। তিন তালাক রদ নিয়ে রাজনীতির যত টানাপোড়েনই থাক, সেই সিদ্ধান্ত মুসলিম মহিলাদের অধিকারের পথেই এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল। আর এবার খোরপোশ ইস্যুতে বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন ও বিচারপতি অগাস্টাইন জর্জ মাসির ডিভিশন বেঞ্চের এই রায় তাঁদের অধিকার আরও একটু পোক্ত করে দিল, এমনটা বোধহয় ভাবাই যায়।
আরও শুনুন:
খোরপোশ স্ত্রীর অধিকার, ভিক্ষা নয়! মুসলিম মহিলাদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থান সুপ্রিম কোর্টের
তিন তালাক মুসলিম পুরুষদের এই সুবিধে দিয়েছিল যে, যে কোনও সময় তিনবার ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই ভেঙে যাবে বিয়ে। বিবাহবিচ্ছেদ সেক্ষেত্রে একইসঙ্গে সহজ এবং দায়িত্বহীন। তিন তালাকের বলে যে কোনও সময় স্ত্রীকে ঘরছাড়া করার অধিকার ছিল কোনও মুসলিম পুরুষের। উলটোদিকে মহিলাদের যে কোনও সময় ঘর ভেঙে যাওয়ার অনিশ্চয়তা তো ছিলই, আবার ঘরের সঙ্গেই পেটে টান পড়ার পথও খোলা ছিল পুরোপুরিই। যাঁরা কোনোভাবেই আর্থিক উপার্জন করেন না, উপরন্তু যাঁরা দুঃস্থ, সহায়সম্বলহীন; এই দায়দায়িত্বহীন বিচ্ছেদ তাঁদের অন্নসংস্থানের কোনও দিশাও দেখায়নি। ২০১৭ সালের ২২ অগস্ট সুপ্রিম কোর্ট সেই তিন তালাক প্রথাকে অবৈধ, অসাংবিধানিক ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ২০১৯-এর মুসলিম নারী আইনে সেই নিষেধে সিলমোহর দেয় কেন্দ্র সরকার। কিন্তু তারপরেও তিন তালাকে বিচ্ছেদ যে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি, অনেকসময়ই খবরের সূত্রে তা জানা যায়। তা ছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষণার আগে পর্যন্ত যেসব বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে, তাও তো নতুন করে পুনর্বিবেচনা করার কথা বলা হয়নি। তিন তালাক রদের পর কেউ এই প্রথা কার্যকর করলে নাহয় সেই পুরুষের শাস্তি হবে, কিন্তু আগেই বিবাহবিচ্ছিন্না সেই মেয়েদের তো কোনও সুরাহা নেই। এহেন নানারকম জটিলতার কারণেই, মুসলিম মহিলাদের একটা বড় অংশের জীবন কিন্তু রয়ে গিয়েছিল অন্ধকারের আড়ালেই।
আরও শুনুন:
তিন তালাক নিষিদ্ধ হতে হিতে বিপরীত! বাড়ছে মুসলিম মহিলাদের উপর অত্যাচারের প্রবণতা
সেখানেই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই সাম্প্রতিক রায়। যা বলছে, তিন তালাকের জেরে বিবাহবিচ্ছিন্না কোনও মুসলিম মহিলাও খোরপোশ দাবি করতে পারবেন। এর ফলে, একদিকে যেমন বেআইনিভাবে কেউ তিন তালাকের পথে হাঁটলে সেখানে পুরুষটির জন্য শাস্তির পাশাপাশি খোরপোশ দেওয়াও বরাদ্দ হবে, একইসঙ্গে অতীতে যাঁরা এই অবিচারের শিকার হয়েছেন, বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া সেই মুসলিম মহিলারাও কিন্তু খোরপোশের দাবিদার হলেন। সোজা কথায়, তিন তালাকে বিবাহবিচ্ছেদের সঙ্গে যে দায়িত্বহীনতা জুড়ে ছিল, এবং সে কারণেই এই সহজ পথে বিচ্ছেদ চাইতেন অনেক পুরুষ, তা আর একইরকম দায়িত্বহীন রইল না। দেশের শীর্ষ আদালত সেই বিষয়টিই নিশ্চিত করে দিল। তার ফলে তিন তালাক রদ প্রক্রিয়া আরও খানিক আঁটোসাঁটো করা গেল বলেই মনে হয়। পাশাপাশি মুসলিম মহিলাদের অধিকারের জায়গাটি দীর্ঘদিন যে অনিশ্চয়তার গ্রাসে ডুবে ছিল, সেই অন্ধকারও বেশ কিছুটা সরিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্টের এই সাম্প্রতিক রায়।