গ্রামবাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দিদি’ হিসেবেই পরিচিত। বলা ভালো, এই ডাক তাঁর পরিচয়ের ভিত্তি। এবার সেই ‘দিদি’ হয়েই কিস্তিমাত করলেন মমতা। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে হাজির হলেন সশরীরে। সর্বসমক্ষে দাঁড়িয়ে বললেন, মুখ্যমন্ত্রী নয়, বড় দিদি হয়ে পাশে দাঁড়াতে চান।
‘দিদি, ও দিদি…’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে নরেন্দ্র মোদির দীর্ঘ সুর টানা আহ্বান। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বারবার শোনা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর গলায়। সম্ভাষণ নয়, এই ডাক কটাক্ষ বলেই চিহ্নিত হয়েছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন, মোদি যে প্রলম্বিত সুরে সম্বোধনের নামে আক্রমণ শানাচ্ছেন, তাতে শ্লেষ ছাড়া কিছুই নেই। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন। বিধানসভার ফলাফল এই বিতর্কে দাঁড়ি টেনেছে। লোকসভার নির্বাচনে বাংলায় প্রচারে এলেও মোদির মুখে আর শোনা যায়নি, ‘দিদি ও দিদি…’।
মোদির ডাকে কটাক্ষ থাকলেও, বাংলার আমজনতার ডাকে তা নেই। বিশেষ করে গ্রামবাংলায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দিদি’ হিসেবেই পরিচিত। বলা ভালো, এই ডাক তাঁর পরিচয়ের ভিত্তি। এবার সেই ‘দিদি’ হয়েই কিস্তিমাত করলেন মমতা। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে হাজির হলেন সশরীরে। সর্বসমক্ষে দাঁড়িয়ে বললেন, মুখ্যমন্ত্রী নয়, বড় দিদি হয়ে পাশে দাঁড়াতে চান। তাঁকে ভরসা করুন ডাক্তাররা, এই আর্জিই রাখলেন। আশ্বাস দিলেন দোষীরা শাস্তি পাবেই। আর এভাবেই যেন বুঝিয়ে দিলেন রাজনীতির ময়দানে অভিজ্ঞতার দাম কতটা।
বাড়িতে মায়ের শাসন থেকে বাঁচানোর আশ্রয়স্থল দিদি। আবার ভুল করে অন্য পথে পা রাখলে, প্রথম কানমলা দেবে দিদি। বয়সের ফারাক যাই হোক, দিদিরা মায়ের মতোই আগলে রাখেন ভাইবোনকে। সাহিত্যেও সে উদাহরণ রয়েছে ভুরিভুরি। ভালোবাসার সম্পর্ক। তাতে রাগ, হিংসা, মারামারি সব আছে। কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। এই দিদির আসনে কাউকে বসালে ভালোবাসার বাঁধনটাও ততটাই মজবুত হয়। বিশেষ করে সেই দিদি যদি বুঝিয়ে দেন, তিনি প্রকৃতপক্ষেই দিদি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এইখানেই জিতে যান বারবার। নির্বাচনী প্রচার হোক, বা দলীয় বৈঠক, দিদি হয়ে শাসনে-ভালোবাসায় সকলের সঙ্গে মিশে যান। যে কোনও সময় মুখ্যমন্ত্রী পরিচয় ভুলে নেমে আসেন ময়দানে। পা মেলান সাধারণ মানুষের মিছিলে। তাতে কটাক্ষ কম হয় না। বিরোধীরা তো বটেই, কোথাও একচুল এদিক ওদিক হলে সমালোচনার বন্যা বয়ে যায়। নেটদুনিয়া সেই অবাধ বিচরনের সুযোগ দেয়। সেখানে চাইলেই যে কাউকে যা খুশি বলা যায়। দিদি পরিচয় মমতা ভুলতে পারেন, কিন্তু বাকিদের কাছে তিনি মুখ্যমন্ত্রী। তাই প্রশাসনিক সমস্যা হলে তাঁকেই কাঠগড়ায় তোলা হয়। শ্লেষ মেশানো দিদি সম্বোধনও জোড়ে সেই সমালোচনার তালিকায়। মমতা এসব দেখেন। কখনও প্রতিক্রিয়াও দেন। তবে নিজের দিদি পরিচয় ভোলেন না।
বিপদের দিনে কন্ট্রোল রুমে রাতের পর রাত জেগে কাটানো। নির্বাচনী বিধি ভুলে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো। এসব মমতার স্বভাবসিদ্ধ। বড়াই করে একথা প্রচারও করেন না। শুধু বলেন তাঁকে ভরসা করতে। প্রশাসনিক বৈঠকেও পরিস্থিতি খুব একটা বদলায় না। সেখানেও দিদির মতো, কার ভুঁড়ি একটু বেড়েছে সেই নিয়ে সচেতন হতে বলেন। রেখে ঢেকে নিজের সত্ত্বার উপর প্রলেপ চাপিয়ে কথা বলা তাঁর সিলেবাসের বাইরে। তিনি দিদি, এটাই তাঁর পরিচয় একথা নিজে মানেন, অন্যদেরও বুঝিয়ে দেন। আর জি কর কাণ্ডের জেরে উত্তাল রাজ্য। বাংলার অশান্ত পরিস্থিতি নিয়েও শুরু থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মমতা। তদন্তের দায়িত্বে থাকা সিবিআইকে অনুরোধ করেছেন দ্রুত সবকিছুর নিষ্পত্তি ঘটানোর। আলোচনায় বসতে চেয়েছেন জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গেও। মুখ্যমন্ত্রী অপেক্ষা করলেও সেই বৈঠক শেষমেশ হয়নি। তা নিয়ে ক্ষোভ নয়, হতাশার সুর শোনা গিয়েছিল মমতার গলায়। সেদিনও বলেছিলেন, দিদি হিসেবে পাশে রয়েছেন। তবে এবার সরাসরি ধর্ণামঞ্চে হাজির হলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনিক পরিচয়ের জোর না দেখিয়ে, দিদি হয়ে সবার সামনে দাঁড়ালেন মমতা। দিদি হয়েই রাজধর্ম পালন করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।