দু-দফা নির্বাচন ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। দেখা গিয়েছ, ভোটদানের হার ক্রমশ কমছে। বা, যতটা আশা করা যায়, ততটা হচ্ছে না। ভিলেন কি শুধু চাঁদিফাটা গরম? নাকি, নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেই ক্রমশ আস্থা হারাচ্ছে জনতা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
নির্বাচন গণতন্ত্রের উৎসব। আর সেই উৎসবে শামিল হওয়া অর্থাৎ ভোট দেওয়া দেশের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক কর্তব্য। এ কথা যে দেশের মানুষ ভুলে গিয়েছেন, তা নয়। অথচ ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া দু-দফা নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, ভোটদানের হার সেভাবে বাড়ছে না। ফলত, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে নতুন সংশয় দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন যে, সামগ্রিক ভাবে হয়তো নির্বাচনের উপরই আস্থা হারাচ্ছেন মানুষ।
আরও শুনুন: ভোটের সাপলুডোয় কে জিতবে আপনার হাতেই? মোবাইলে চোখ রাখলেই কেল্লাফতে
তবে, এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে যেভাবে তাপপ্রবাহ চলছে, তাকেও ভিলেন হিসাবে দেখা যেতে পারে। গরম থেকে বাঁচতে অনেকেই বুথমুখো হচ্ছেন না, তা সত্যি। সেটাই একমাত্র কারণ হলে হয়তো চিন্তার কিছু ছিল না। তবে, ভোটদানের হার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে পাশাপাশি রেখে যে ট্রেন্ড খেয়াল করেছেন পর্যবেক্ষকরা, তাতে শুধু গরমকে কাঠগড়াতেই তোলা যাচ্ছে না। ভোটদানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনের মান উন্নয়নের একটা সম্পর্ক থাকে। মূলত সেই উন্নয়নের খাতিরেই মানুষ গিয়ে ভোট দেন। কাজেই ভোট দেওয়া থেকে যদি বিরত থাকেন মানুষ, তাহলে ধরে নিতে হবে, নির্বাচন যে তাঁদের জীবনে কোনও পরিবর্তন আনবে, এমন বিশ্বাসই হয়তো তাঁদের হারিয়ে গিয়েছে। যা আসলে সংসদীয় গণতন্ত্রকেই সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেই আর সামগ্রিক ভাবে মানুষ ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন কি-না, এ প্রশ্নও তাই উঠে যায়।
আরও শুনুন: নির্বাচনে জিতবেন কে? ভোট এসেছিল মহাকাশ থেকেও
নির্বাচন নিয়ে সবথেকে হতাশ বোধহয় দেশের তরুণ প্রজন্ম। বিশেষত, যাঁরা প্রথম কি দ্বিতীয়বার ভোট দিচ্ছেন। দেশের ভবিষ্যতের ভার তাঁদের উপরই। তবে, রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে প্রতি মুহূর্তে নিজেদের ভাঙছে, জুড়ছে তাতে বিশ্বাসযোগ্যতায় বড় প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে। তরুণদের মত, ভোটদানের গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁরা পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। কিন্তু তরুণরা কী চাইছেন, সে সম্পর্কে নেতারা কি আদৌ চিন্তিত? তাঁরা চাকরি পাবেন কি-না, তাঁদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, এরকম কোনও কথাই তাঁরা জানতে বা শুনতে পান না। উপরন্তু, একদিন এই নেতা আছেন এক দলে, তো পরদিনই অন্য দলে। ফলত যাঁকে ভোট দেবেন, তিনি আদৌ দায়বদ্ধ থাকবেন কি-না, এ প্রশ্ন বেশ জোরালো হয়েই উঠেছে তরুণ প্রজন্মের মনে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন কেবল তরুণদের মনে নয়; দেশের বহু মানুষকেই ভাবাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতা। রুটি-রুজি থেকে শুরু করে সামাজিক সুরক্ষা, এবং অন্যান্য বিষয়ে ভোট মিটলে আদৌ নেতারা দায়বদ্ধ থাকবেন কি-না, তা গভীর সন্দেহের বিষয়ই হয়ে উঠেছে তাঁদের কাছে। পাশাপাশি, ভোটের যে ন্যারেটিভ বা রাজনৈতিক বয়ান নির্মাণ করা হচ্ছে, তাও হয়তো তাঁদের সেভাবে আকর্ষণ করছে না। অর্থাৎ সেই বয়ানের মধ্যে তাঁদের জীবন কীভাবে বদলাতে পারে, তা তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না। এই অনাস্থার জায়গা থেকেও ভোট দেওয়ার হার কমতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
এদিকে ভোট দেওয়ার হার যদি কমে, তাহলে তা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই আখেরে কমিয়ে দেয়। কম ভোটদানের মধ্যে যখন কোনও নেতা জয় হাসিল করেন, তিনি আসলে গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের সমর্থন পান না। তবে, নির্বাচনের পদ্ধতিগত কারণেই তাঁর কাছে জয় ধরা দেয়। তা আসলে অঙ্কের হিসাবে। তবে, সেই অঙ্ক আবার ঘুরিয়ে সমাজের উপরই প্রভাব ফেলে। কেননা এরকম পরিস্থিতিতে নেতার দায়বদ্ধতা বা প্রতিশ্রুতিরক্ষার পরিসরও ক্রমশ ছোট হয়ে আসে। ফলে রাজনৈতিক দল আর ক্ষমতাশীলদের হাতেই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ তাঁদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন। যা আসলে গণতন্ত্রকেই ভঙ্গুর করে তোলে।
আরও শুনুন: মানুষ নয়, ভোটে দাঁড়াল গরু! ব্যাপারটা ঠিক কী?
বিশেষজ্ঞদের তাই মত, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন দেশের মানুষের ভোট দেওয়া উচিত। এমনকী পছন্দের প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা কম জেনেও ভোট দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা তা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে জোরদার করে। তা না থাকলে কোনওভাবেই গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য উদ্ধার করা সম্ভব নয়।