দিনকয় আগেও কর্ণাটকের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছিল সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রশ্নে। শাসক ও বিরোধী দলের নেতারা তোপ দাগছিলেন পরস্পরের বিরুদ্ধে। তা যে একেবারে মুছে গেছে তা নয়। তবে সব বিতর্ক আপাতত চাপা পড়েছে ভাষার প্রশ্নে। হিন্দি ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ভাষা নয়। এই বিবৃতিতে এখন এককাট্টা সে রাজ্যের সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা-মন্ত্রীরা।
রাজনৈতিক পরিচয় ধরতে গেলে, তাঁদের কেউ বিজেপি নেতা, কেউ-বা কংগ্রেসের। কেউ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, কেউ-বা প্রাক্তন। কিন্তু সেই সব পরিচিতি পিছনে ফেলে বর্তমানে সবাই একজোট। কর্ণাটকের রাজনীতি যেন রাতারাতি সব বিভাজন, বিরোধিতা ভুলে বইতে শুরু করেছে একখাতে। আর এই মিলনের বিন্দুটি হল ভাষা। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, মাতৃভাষা। মাতৃভাষার উপর অন্য ভাষার আগ্রাসন আর ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই বিভাজন ভুলেছেন কর্ণাটকের নেতা-মন্ত্রীরা। আর তাই অভিনেতা সুদীপের হয়ে একযোগে সওয়াল করলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামী। সুদীপের পাশেই দাঁড়িয়েছেন সে-রাজ্যের বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সিদ্দারামাইয়াও।
আরও শুনুন: অবাক কাণ্ড! হোটেলের খরচ লাগেই না অথচ সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় এই পরিবার, কীভাবে?
ভাষার উপর আঘাতটা এসেছিল বলিউড স্টার অজয় দেবগণের থেকে। সম্প্রতি দক্ষিণী অভিনেতা সুদীপ কিচ্চা তাঁর বক্তব্যে সাফ জানিয়েছিলেন, হিন্দি দেশের রাষ্ট্রভাষা নয়। অভিনেতার কথা মেনে নিতে পারেননি অজয়। পালটা জানিয়েছিলেন, হিন্দি দেশের রাষ্ট্রভাষা ছিল এবং থাকবে। সম্প্রতি দক্ষিণী ছবি যেন বলিউডের পায়ের নিচের জমি কেড়ে নিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে সিনে-ইন্ডাস্ট্রির অর্থনীতিও। সেই লড়াই-তে খুব স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়েছে ভাষার প্রসঙ্গও। বাগযুদ্ধ চলছিল দুই অভিনেতার। এবার তাতে লাগল রাজনৈতিক রং। আবার এই একই প্রশ্নে রাজনীতির রং ভুললেন কর্ণাটকের নেতা মন্ত্রীরা।
আরও শুনুন: সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সামনে ‘ঝুঁকেগা নেহি’, বৃদ্ধার মনোবল দেখে অবাক মহারাষ্ট্র
মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই স্পষ্ট জানিয়েছেন, অভিনেতা সুদীপ যা বলেছেন তা সঠিক। প্রত্যেকটা অঞ্চল বা রাজ্যের গঠনের ক্ষেত্রে নিরিখে ভাষা আলাদা ভিত্তি হিসাবে পরিগণিত এবং তাই আঞ্চলিক ভাষা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বক্তব্য, অভিনেতা সুদীপ যা বলতে চেয়েছেন তা সকলেরই অনুধাবন করা উচিত। একই মত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামীরও। সুদীপের পাশে দাঁড়িয়ে তিনিও বলেছেন, হিন্দি রাষ্ট্র ভাষা নয় বলে যে দাবি অভিনেতা করেছেন তা সর্বৈব সত্যি। তাঁর বক্তব্যে কোনও ভুল নেই। বরং অভিনেতা অজয় দেবগণ যেরকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথায় সুদীপকে আক্রমণ করেছেন তারই নিন্দা করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সিদ্দারামাইয়া অজয় দেবগণের কথার সুর নকল করেই তাঁকে জবাব দিয়ে জানিয়েছেন, হিন্দি কোনোদিন রাষ্ট্রভাষা ছিল না, কোনওদিন হবেও না। প্রত্যেক ভাষার সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে জানিয়ে প্রবীণ নেতা বলেন, দেশের সকল নাগরিকের উচিত ভারতবর্ষের এই ভাষাগত বৈচিত্রকে স্বীকার করা এবং সম্মান জানানো। কর্ণাটকের কংগ্রেস সভাপতি শিবকুমার বলেছেন, দেশের মানুষ কয়েক হাজার ভাষায় কথা বলেন। ভাষা যাই হোক না কেন বা যে ভাষাতেই বলা হোক না কেন, দেশকে ভালবাসার অনুভব সকল ভাষাভাষীর ক্ষেত্রেই একই রকম অনুভূত হয়। ভাষার ভিত্তিতে আলাদা রাজ্যের জন্মই হয়েছিল, যাতে কোনও ভাষা আর এক ভাষার উপর কর্তৃত্ব স্থাপন না করতে পারে।
অর্থাৎ হিন্দি আগ্রাসন যখন মাতৃভাষাকে গ্রাস করতে চায়, তখন রাজনীতি ভুলে এক ছাতার তলা শামিল সে রাজ্যের প্রায় সকল নেতা মন্ত্রী। এই কিছুদিন আগেও কর্ণাটকের রাজনীতিতে যেন বিভাজন, সম্প্রদায়গত বিভেদের ফাটলগুলিই কেবল স্পষ্ট হচ্ছিল। নেতারা পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে সরগরম করে তুলেছিলেন রাজনীতির ময়দান। রাজনীতি না পারলেও, ভাষা কিন্তু তাঁদের একজোট করতে পেরেছে। তৈরি হয়েছে বৃহত্তর ঐক্য। মাতৃভাষা আসলে ঘরের মতোই, এক অন্যরকম আশ্রয়। রাজনীতির আদর্শ যাই হোক না কেন, ভাষার সেই আশ্রয়ের নিরিখে সব ভেদাভেদ যে নিমেষে মিটে যেতে পারে, সেই কথাটাই আবার যেন মনিয়ে করিয়ে দিলেন কর্ণাটকের নেতা-মন্ত্রীরা।