প্রয়োজনের খাতিরে তিনি হয়েছিলেন রাজনীতিবিদ। হয়তো আকস্মিকই। বিরোধী রাজনীতি নিজের ধর্মেই তাঁকে আক্রমণ করতে ছাড়েনি। তবে রাজনীতি তাঁকে বেঁধেও রাখতে পারেনি। যে ভারতবর্ষকে এক কালে সোনা বন্ধক রাখতে হয়েছিল, সেখান থেকে দেশের যে উড়ান তিনি সম্ভব করে তুলেছিলেন তা স্বীকার না করে উপায় কী! বিরোধী রাজনীতি তাই তাঁকে আক্রমণ করলেও অস্বীকার করতে পারেনি।
লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
সে বড় কঠিন সময়৷ নির্বাচনী প্রচারসভায় গুপ্তঘাতক হত্যা করেছে রাজীব গান্ধীকে৷ রাজীবের আকস্মিক প্রয়াণ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার সুযোগ করে দিয়েছিল রাজনীতি থেকে প্রায় অবসর নেওয়া পিভি নরসীমারাওকে৷ শুধু রাজনৈতিক বিপর্যয় নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও তখন দেশের বড়ই বেহাল দশা৷
যেদিন নরসীমা রাও প্রধানমন্ত্রী হন, সেদিন মন্ত্রিপরিষদের সচিব নরেশ চন্দ্র তাঁকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির হাল জানান ৷ সব শুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রথমে ইচ্ছা ছিল আই.জি. প্যাটেলকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়ে আসার। সেই সিদ্ধান্ত যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। আসলে ওই পরিস্থিতিতে নরসীমা রাও চাইছিলেন, অর্থমন্ত্রীর পদে একজন পেশাদার অর্থনীতিবিদকে প্রয়োজন। নিছক একজন রাজনীতিবিদের কথা ভাবেননি। কেননা তিনি ভাবছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্বের কথা, যাঁর রয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা। যখন দেখা গেল আই.জি. প্যাটেল ব্যক্তিগত কারণে অর্থমন্ত্রী হতে অস্বীকার করলেন, তখন নরসিমা রাও দ্বিধাহীনভাবে মনমোহন সিংকে বেছে নেন। নরসীমা রাওয়ের এই একটি সিদ্ধান্তই যেন আসন্ন বিপ্লবের বীজতলা। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বদলে মনমোহন সিংকে বেছে নেওয়ার দরুন দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে গেল। আর কঠিন সময়ে এমন গুরুদায়িত্ব নিয়ে মনমোহন ভারতের অর্থনীতিতে বিপ্লব আনলেন৷ ইতিহাসের সেই শুরু।
দায়িত্ব পেয়ে আর্থিক পরিস্থিতি সামাল দিতে এবার শুরু হল একের পর এক ‘মনমোহনী সংস্কার’৷ ১৯৯১ সালে ২১জুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন নরসীমা রাও৷ দায়িত্ব পেয়ে তিনি ও তাঁর অর্থমন্ত্রী আর্থিক সংকট কাটানোর উপায় খুঁজতে অর্থমন্ত্রকের অফিসারদের পাশাপাশি রিজার্ভ ব্যাংকের কর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসলেন৷ বিদেশের পাওনা মেটাতে গিয়ে নাজেহাল ভারত৷ আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার মূল্য নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন৷
দেশের নীতি নির্ধারকরা অনুভব করলেন আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় টাকার দাম প্রকৃত দামের চেয়ে অনেক বেশি৷ অর্থাৎ প্রয়োজন টাকার অবমূল্যায়ন করা৷ অবশেষে তা করা হল ১ জুলাই৷ ভবিষ্যতে টাকা নিয়ে ফাটকাবাজি আটকাতেই এমন পথ বেছে নিলেন অর্থমন্ত্রী৷ ডলারের বিনিময় মূল্য ২১ টাকা ১৪ পয়সা (৩০ জুনের বিনিময় মূল্য) থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াল ২৩ টাকা ৪ পয়সায়৷ দু’দিন পরে ৩ জুলাই দ্বিতীয়বার টাকার অবমূল্যায়ন করতে হল৷ ডলারের বিনিময় মূল্য গিয়ে দাঁড়াল ২৫ টাকা ৯৫ পয়সা৷
সেদিনের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের কয়েক মাস আগে অবশ্য চন্দ্রশেখর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন দেশের আর্থিক সংকট অন্য মাত্রা নিয়েছিল৷ একদিকে উপসাগরীয় যুদ্ধ অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের জেরে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছিল৷ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে আমদানি করা তেলের বিল মেটাতে এদেশের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা৷ ফলে তখন দুটি অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল চন্দ্রশেখরকে৷ এক, দেশের সঞ্চিত সোনা বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া এবং দুই, উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন বিমানকে তেল ভরার জন্য এদেশের বিমানবন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া৷ এর কয়েক মাস পরেই লোকসভা ভোটের পর আসে নরসীমা রাওয়ের সরকার৷ তবে আর্থিক পরিস্থিতি তখনও তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি৷ দেখা গেল ভারতের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ের ভাণ্ডার ১৯৯১ সালের জুনে দাঁড়িয়েছে ১১২৪ মিলিয়ন ডলার যা দু’সপ্তাহের আমদানি বিল মেটাতে পারে৷ সংকটমোচন তখন অবমূল্যায়ন৷
অবমূল্যায়ন ঘিরে তখন বিরোধীরা সরকারের সমালোচনায় মুখর৷ ‘আইএমএফের নির্দেশে চলছেন দেশের নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রী’ বলে আওয়াজ উঠল৷ সেদিন মনমোহনের যুক্তি ছিল- এই পদক্ষেপের ফলেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে টাকা নিয়ে ফাটকা কমবে এবং ভারতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে আস্থা বাড়বে৷ এরপর ২৪ জুলাই মনমোহন সিং পেশ করলেন তাঁর প্রথম বাজেট৷ পাশাপাশি এল ১৯৯১ সালের শিল্পনীতি ৷ যেখানে বেসরকারি বিনিয়োগে জোর দেওয়া হল৷ সুদের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলি কিছুটা স্বাধীনতা পেল৷ অবসান ঘটল লাইসেন্স রাজের এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে বিদেশি প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসার সুযোগ বাড়ল৷ ভারতের মানুষ পরিচিত হতে থাকল কতগুলি নতুন শব্দের সঙ্গে- মুক্ত অর্থনীতি, বেসরকারিকরণ, বিশ্বায়ন৷ বোঝা গেল পৃথিবীটাই একটা ‘গ্লোবাল ভিলেজ’৷ বিদেশিদের জন্য ধাপে ধাপে বিনিয়োগের দরজা খুলতে থাকল৷ অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে ভর্তুকি কমানোর পথে হাঁটতে হল৷ করের হার কমিয়ে করের আওতায় অনেক বেশি লোককে এনে শুরু হল কর সংস্কার৷ বদলে ফেলা হল শেয়ার বাজারটাকেও৷ কন্ট্রোলার অফ ক্যাপিটাল ইস্যুর বদলে সেবি এল৷ আত্মপ্রকাশ করল ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ৷ একের পর এক সংস্কারের ঘোড়া ছুটিয়ে ভারতবর্ষে আর্থিক বিপ্লব ঘটালেন যে মানুষটি, তিনি মৃদুভাষী ড. মনমোহন সিং।
তারপর তিন দশকের বেশি সময় কেটে গিয়েছে, গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে৷ ইতিমধ্যে কখনও মনমোহনের দল কংগ্রেস কেন্দ্র থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে আবার কখনও বা ক্ষমতায় ফিরলে তাঁকেই সামলাতে হয়েছে আরও গুরুদায়িত্ব- অর্থমন্ত্রীর বদলে একেবারে প্রধানমন্ত্রী হতে হয়েছে মনমোহনকে৷ তবে দিল্লিতে কংগ্রেস ক্ষমতা হারালেও যারাই ক্ষমতাই এসেছে যুক্তফ্রন্ট কিংবা এনডিএ কেউই সেভাবে মনমোহনের অর্থনীতিকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি৷ দেখা গিয়েছে রাজনৈতিক কারণে যতই কংগ্রেস-বিরোধীরা মনমোহনের বিরোধিতা করুক না কেন, তারাই ক্ষমতায় এসে সরকার চালাতে গিয়ে সেই মনমোহনের দেখানো সংস্কারকে একেবারে সরিয়ে পুরোপুরি উল্টো পথে হাঁটতে পারেনি।
ভারতীয় রাজনীতিতে মনমোহন সিং তাই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। প্রয়োজনের খাতিরে তিনি রাজনীতিবিদ হয়েছেন। রাজনীতি নিজের প্রয়োজনে তাঁকে অনেক কথাও শুনিয়েছে। বিদ্রুপ করেছে। তবু রাজনীতি যেন তাঁকে সংকীর্ণতায় বেঁধে ফেলতে পারেনি। বিরোধিতার রাজনীতি তাঁকে আক্রমণ করেছে, অস্বীকার করতে পারেনি। বরং একান্তে সম্ভ্রমে তাঁকে স্বীকারই করে নিয়েছে নতুন এই ভারতবর্ষ।