প্রতি ১৩ দিনে একজন অভিযুক্তকে হত্যা করা হয় এ রাজ্যে। কারণ মুখ্যমন্ত্রীর সাফ বক্তব্য, অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে, আর তা মৃত্যুই। আর যোগী আদিত্যনাথের এহেন নির্দেশের জেরেই গত সাত বছরে প্রায় ১৩ হাজার ছুঁয়েছে পুলিশের এনকাউন্টারের সংখ্যা।
ভয়ংকর অপরাধের প্রেক্ষিতে বারবার দাবি ওঠে, অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক। যদিও অনেকে বলেন, কেবল কঠোর শাস্তিতেই অপরাধের প্রবণতা কমে না, বরং তড়িঘড়ি কড়া শাস্তি দেওয়ার বদলে অপরাধের শিকড়ে পৌঁছনো বেশি জরুরি। তবে অপরাধের পরবর্তী জনরোষ তো সে কথা শুনতে রাজি নয়। তাদের সুরে সুরে মিলিয়েই, অনেকসময় প্রশাসনও মৃত্যুদণ্ডের পথেই হাঁটে। আর এই তৎপরতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সামনে হয়তো থাকবেন যোগী আদিত্যনাথই। অপরাধীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতেই চলতে চান উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। পর্দার ‘সিঙ্ঘম’-এর মতোই, অপরাধীদের সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিবিধান করার পক্ষপাতী তিনি। তাই যোগীরাজ্যে হামেশাই শোনা গিয়েছে ‘ঠোক দো’ বুলি। যদিও দেশের সংবিধান বলে, যে কোনও অপরাধীরও বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু আদালতে দীর্ঘ বিচার এবং তারপর অপরাধীকে সাজা শোনানো, এই আইনি পথে হাঁটার বদলে বারে বারেই অপরাধীদের সঙ্গে এনকাউন্টারে জড়িয়েছে যোগীরাজ্যের পুলিশ। এমনকি খোদ আদিত্যনাথের গলাতেও এই দাবি শোনা গিয়েছে, যে, তাবড় তাবড় গ্যাংস্টারেরা এনকাউন্টার নীতির ভয়ে কাঁপছে। যোগী আদিত্যনাথের কথাকেই যেন কার্যত সমর্থন করে সে রাজ্যের এনকাউন্টারের পরিসংখ্যানও। যা জানাচ্ছে, যোগী আদিত্যনাথ সরকারের আমলে গত সাত বছরে প্রায় তেরো হাজার ‘এনকাউন্টার’ হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। সংবাদ সংস্থা সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০১৭ সালের ২০ মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে পুলিশের এনকাউন্টারের মোট সংখ্যা ১২ হাজার ৯৬৪। গড়ে ১৩ দিনে একজন অভিযুক্তের মৃত্যু ঘটেছে পুলিশি এনকাউন্টারে।
উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় আসার পরই যোগীর সরকার মাফিয়া, দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নেয়। তখন থেকেই ঢালাও ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশ প্রশাসনকে। তারই ফল এই বিপুলসংখ্যক এনকাউন্টার। পুলিশের দাবি, যাঁদের এনকাউন্টার করা হয়েছে, এদের সকলেই দাগি আসামি। তাদের অনেকেরই বিরুদ্ধে আর্থিক পুরস্কারের ঘোষণাও করা হয়েছিল। খতমদের তালিকায় রয়েছে এমন ২ আসামি, যাদের প্রত্যেকের মাথার দাম ৫ লক্ষ টাকা ঘোষণা করেছিল যোগী সরকার। ৪ জনের বিরুদ্ধে ছিল আড়াই লক্ষ টাকার পুরস্কার। শুধু মিরাটেই এখনও পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৭২৩টি এনকাউন্টারে ৬৬ জন কুখ্যাত অপরাধীকে হত্যা করা হয় এবং গ্রেপ্তার করা হয় ৭ হাজার ১৭ জন দুষ্কৃতীকে। নিহতের তালিকায় রয়েছে ২০৭ জন কুখ্যাত অপরাধী। অন্যদিকে অপরাধীদের পাল্টা প্রতিরোধে মৃত্যু হয়েছে ১৭জন পুলিশ কর্মীরও। কথা হচ্ছে, এই নিহতদের মধ্যে অনেকেই নাহয় কুখ্যাত অপরাধী। কিন্তু বিচার শেষের আগে অভিযুক্ত মাত্রেই অপরাধী এমন কথা তো বলা যায় না। আর সেইখানেই এই এনকাউন্টারের অভ্যাস বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
কোনও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ শাস্তির চল সবসময়েই কম। বরং অপরাধীদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব কি না, তা দেখার জন্য এ দেশে জেলগুলিকে সংশোধনাগারে বদলানোর কথাও ভাবা হয়েছে। দেশে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা, এমনকী জম্মু-কাশ্মীরের মতো অশান্ত অঞ্চলেও পুলিশের গুলিতে এত মানুষের মৃত্যুর নজির সাম্প্রতিককালে নেই। সেখানে পুলিশের হাতে এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে দেশের শীর্ষ আদালতও। তদন্ত কোন পর্যায়ে ছিল, সংঘর্ষে মারা যাওয়ার আগে অপরাধীকে ধরতে পুলিশ কী ধরনের পদক্ষেপ করেছিল, নিহতদের বিরুদ্ধে কী কী ধরনের অপরাধ ছিল এবং আদালতে বিচার সম্পন্ন হলে সেই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা কী হতে পারত, এই সবকিছু জানতে চেয়ে যোগী সরকারের কাছে আগেই রিপোর্ট তলব করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। তবে সুপ্রিম কোর্টের সেই পদক্ষেপের পর বছর ঘুরলেও যোগী প্রশাসন যে নিজের পুরনো অবস্থানেই অনড় হয়ে আছে, তা-ই বুঝিয়ে দিল এই সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান।