বেপরোয়া গতি। পথচারীর মৃত্যু। ঘাতকের মুখে শিবের নাম। ভগবানের নামে কি সাত খুন মাফ হতে পারে! এমন ধারনার জন্মই বা কোথা থেকে?
কয়েকটা দৃশ্যের কথা ভাবা যাক,
রাতের শো। তুমুল ভিড়। মঞ্চে সেরা গায়িকা। একটার পর একটা হিট গাইছেন, হাততালির ঝড় উঠছে। আর সেইসঙ্গে দর্শকদের চিৎকার, ‘ওয়ান্স মোর, ওয়ান্স মোর’! কিংবা, পাড়া ক্রিকেটের হাইভোল্টেজ ম্যাচ। রাস্তার মাঝেই খেলা। ঠাসা ভিড়। ক্রিজ কামড়ে টিকে আছেন পাড়ার সেরা ব্যাটসম্যান। কবজির মোচড়ে, একটার পর একটা দুরন্ত শট। হাততালির ঝড়। আবার সেই চিৎকার, ‘ওয়ান্স মোর, ওয়ান্স মোর’!
দুটো দৃশ্যই কল্পনা করতে তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অনেকেই হয়তো বাস্তবে এমন ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন। কিন্তু, ভেবে দেখুন তো-
রাতের হাইওয়ে। দুরন্ত গতিতে একটার পর একটা গাড়ি ছুটে চলেছে। এরই মাঝে একটা কালো গাড়ি, বেশ ভালোরকমের গতিতে, সামনের একটা স্কুটারে ধাক্কা মারল। অনিয়ন্ত্রিত গতিতেই আরও খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেল স্কুটারটাকে। ওই অবস্থায় একটু দূরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা আরও কয়েকজনকে ধাক্কা মেরে থামল। স্কুটারের আরোহী, আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই কজন, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। বীভৎস দৃশ্য। তবু চেষ্টা করলে কল্পনা করা যায়। কিন্তু এরপর যা হল, তা ভাবা কঠিন। বাস্তবে তো নয়ই, কল্পনাতেও এই ধরনের দৃশ্য আঁকতে পারবেন না অনেকেই।
ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর ওই কালো গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এক যুবক। উন্নত প্রযুক্তির বলে তাঁর কিছুই তেমন হয়নি। তবে ইনি চালক নন। আতঙ্কের ছাপ চোখে মুখে স্পষ্ট। একহাতে কোনওক্রমে মুখ, ঢেকে চালকের দিকে ইশারা করতে করতে সরে গেলেন। মুখে একটাই বুলি ‘আমি কিছু করিনি’। এবার পালা চালকের। দামী গাড়ির ‘এয়ার ব্যাগ’ তাঁকেও সুরক্ষিত রেখেছে। অক্লেশে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। চেহারা দেখে বোঝা যায়, যুবক। হয়তো মদ্যপ। তবে আচরণ একেবারে ভাবনার বাইরে। বীরদর্পে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলেন। এইসময় একটা কথা বেশ জোরে জোরে বলতে শোনা গেল তাঁকে, ‘অ্যানাদার রাউন্ড, অ্যানাদার রাউন্ড’! অনেকটা ‘ওয়ান্স মোর’-এর মতো। এখানেই শেষ নয়, সামনে গিয়ে যেতে যেতে, শিবের নাম জপতে শুরু করলেন তিনি। গলায় থাকা হার, সম্ভবত রুদ্রাক্ষের মালা, বের করে দেখালেন। উচ্চৈস্বরে শিবের নাম করতে করতে এগিয়ে গেলেন। এদিকে, যারা মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা যে মারাত্মক আহত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরে জানা গেল, দুজন ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছেন।
কল্পনা করতে অসুবিধা হলেও, এ দৃশ্য বাস্তবের। ঘটনাস্থল গুজরাট। রাস্তাঘাটে এই ধরনের দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে ঘাতকের এমন আচরণ, এর আগে চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। ঘটনার ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে। সেখানে দুর্ঘটনার দৃশ্য না থাকলেও, তার পরমুহূর্ত থেকে সবটা স্পষ্টভাবে ধরা আছে। বিশেষ করে ওই যুবকের আচরণ। ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে গাড়িতে থাকা দুই যুবককেই। তাতেই জানা গিয়েছে, অভিযুক্ত না মদ্যপ ছিলেন না তাঁর কোনও মানসিক বিকার রয়েছে। তাহলে কি ইচ্ছা করে? ঘটনার তদন্ত চলছে। তবে যেভাবে অজানা, অচেনা কয়েকজনকে গাড়ি চাপা দিয়েছেন ওই যুবক, তাতে ঘটনার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করছে না ওয়াকিবহাল মহল। বরং চিন্তা বাড়াচ্ছে, ঘটনার পর তাঁর আচরণ। চোখের সামনে কয়েকজনকে চাপা দিয়ে কীভাবে ‘অ্যানাদার রাউন্ড’, বলতে পারেন তিনি? তার ওপর ভগবানের নাম নিয়ে ওমন চিৎকার! কী বোঝাতে চাইলেন, শিবের নাম নিলে সাত খুন মাফ হয়ে যাবে? শাস্ত্রে তো কোথাও এমনটা বলা নেই!
আসলে, বিষয়টা ধর্ম দিয়ে ভাবলে চলবে না। বরং ধর্মকে যেভাবে সমাজের একাংশ ব্যবহার করছেন, সেই প্রসঙ্গ ধরে ভাবা যেতে পারে। বিগত দশকে, হিন্দুধর্মকে সামনে রেখে এমন অনেক কিছুই করা হচ্ছে, যা দেখে গড় ধারণা হতে পারে এমনটা ধর্মের নিয়ম। দোলের দিন মসজিদ ঢাকা দেওয়া, কিংবা এই ধরনের যেসব ঘটনা অহরহ চারপাশে ঘটে চলেছে, এবং তার কারণ হিসেবে যেভাবে হিন্দু ধর্মকে সামনে রাখা হচ্ছে, তাতে অনেকের মনেই ভ্রান্ত ধারণা জন্মাবে। এই ঘটনার ক্ষেত্রেও হয়তো সেই ভ্রান্ত ধারণাই বিশেষ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, ওই যুবকের বিশ্বাস, এই ধরনের অপরাধ করে ভগবানের নাম নিলেই সাত খুন মাফ হয়ে যাবে! আর তাই এতজনকে আহত করেও অক্লেশে গলায় থাকায় রুদ্রাক্ষ দেখিয়ে তিনি উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘অ্যানাদার রাউন্ড’ !