ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধিতার প্রভাব যেভাবে দুই দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাতে কি কোনও লাভ হচ্ছে সে-দেশের সাধারণ মানুষের? সবথেকে বড় এই প্রশ্নটিই যেন ডামাডোলে চলে যাচ্ছে সবথেকে আড়ালে।
রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকেই বাংলাদেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। সেই বদলের ভরকেন্দ্রে চলে এসেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতি ‘বিদ্বেষ’। হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় প্রভুর গ্রেপ্তারি যেন সেই বিদ্বেষের আগুনে ঘি ঢেলেছে। সম্প্রতি বিএনপি নেতা রুহুল কবীর রিজভি তো বাংলা-বিহার-ওড়িশা দাবি করে একরকম যুদ্ধের হুঁশিয়ারিই দিয়েছেন। বলেছেন, ‘যদি ভাবেন, হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশ আপনারা কবজা করে নেবেন, এমন অশুভ ইচ্ছা যদি থাকে, তাহলে আমরাও বাংলা-বিহার-ওড়িশা দাবি করব। ওটা আমাদের নবাবের এলাকা। ন্যায্য অধিকার।’ এদিকে লন্ডনের সমাবেশে ভারচুয়াল বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে গরিব দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ করে তুলেছিল আওয়ামি লিগ। আমার অপরাধ, আমি সাধারণ মানষের উন্নতির জন্য কাজ করেছি। একদিন গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড ফ্যাসিবাদী ইউনুসের বিচার হবেই। এই অন্ধকার কেটে যাবে, নতুন সূর্য উদিত হবে বাংলাদেশে।’ দুই বক্তব্যকে পাশাপাশি রাখলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তাপের আঁচ মেলে। তার প্রভাব এসে পড়ছে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কেও। দুই পড়শি দেশের মানুষের মধ্যে যে স্বাভাবিক সুসম্পর্ক ছিল তা-ও যেন ক্রমশ তলানিতে এসে ঠেকছে। বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ভুল কিংবা অপতথ্যের প্রচার প্রসারের দরুণ, বিদ্বেষের মাত্রা দিনে দিনে বেড়েছে।
আরও শুনুন: বাংলাদেশিরাই খাবার সরবরাহ করছে ভারতে! বলছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, কী করণীয়?
প্রশ্ন হল, এই রাজনৈতিক বিবাদে আদৌ কি লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশ? সে-দেশের সাধারণ মানুষ?
পোশাক তৈরির ব্যবসা বাংলাদেশের অন্যতম উপার্জনের কেন্দ্র। দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক পরিবেশ যত ডামাডোলের দিকে এগোচ্ছে, তত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মুখ ফেরাচ্ছে সে-দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর থেকে। অস্থির পরিবেশ যে ব্যবসার জন্য অনুকূল নয়, এই স্বাভাবিক সমীকরণেই বিশ্বাস করছেন সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। এই পরিস্থিতিতে বরং সংস্থাগুলির লক্ষ্য হয়ে উঠেছে ভারত। সুরাটের পোশাক ব্যবসা এই পরিস্থিতিতে বাড়বে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। একই রকম ব্যবসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, নয়ডার টেক্সটাইল হাবগুলোতেও। ভারতের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের মনোভাবের প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও। সন্দেহ নেই যে, দুই দেশের ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক সম্পর্কের অবনতি হলে ক্ষতি যত না রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তার থেকেও বেশি সে-দেশের সাধারণ মানুষের। অথচ এই মুহূর্তে রাজনীতির জল যেভাবে গড়াচ্ছে, তাতে সেদিকে তেমন নজর পড়ছে বলে মনে হয় না।
আরও শুনুন: ইতিহাস দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপের ইতিহাস ঠেকানো মুশকিল! পড়শি দেশে দেশে তাই এত বিদ্বেষ?
প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক যে চিরকাল একই রকম থাকবে, তা না-ও হতে পারে। ইতিহাস বদলে বদলে যায়। ভারত আর বাংলাদেশের অতীত যে-সুতোয় বাঁধা, তাতে রাজনৈতিক বিভেদ সত্ত্বেও প্রতিবেশী নাগরিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক মোটামুটি বজায় ছিল। অর্থনীতি আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে মসৃণ চলাচল, তা রাজনীতি তেমন করে কেড়ে নিতে পারেনি। সেই পরিস্থিতি সাম্প্রতিক অতীতে প্রায় পুরোপুরি পালটে গিয়েছে বলা যায়। ভারতের প্রতি বিদ্বেষ যেন সে-দেশের রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। এর কারণ নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখবেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তবে, এ কথা ঠিক যে, পড়শি দেশের প্রতি বিদ্বেষ উসকে দিয়ে যে রাজনীতি চলে, সেই ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দৈন্য বাড়ে সাধারণ মানুষেরই।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের দিকে নজর রেখেই এ-কথা বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। একদিকে কাল্পনিক এক শত্রু খাড়া করে মেতে ওঠেন মানুষ। সেই ফাঁক দিয়ে গলে যায় অর্থনীতির চিন্তা। সাধারণ মানুষের স্বচ্ছল জীবনযাপনে স্বপ্ন যেন জায়গা হারায়, বদলে কখনও ধর্ম, কখনও প্রতিবেশীর প্রতি বিদ্বেষ মুখ্য হয়ে উঠে আসে। অন্যদিকে যত দৈন্য বাড়ে, তত বিদ্বেষকেই পরিচিতি বা অস্তিত্বের চিহ্ন হিসাবে আঁকড়ে ধরেন অসহায় মানুষ। এ-এমন এক অলাতচক্র, যা মানুষকে ঘুরিয়ে মারে, কিন্তু এর থেকে মুক্তির পথ মেলে না। দেখা গিয়েছে, পৃথিবীর যে অঞ্চলেই উগ্রশক্তির উত্থান হয়েছে, সেই অঞ্চলেই নেমে গিয়েছে সাধারণ মানুষের জীবনের মান।
বাংলাদেশ কি সেই পথেই এগোচ্ছে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই এর জবাব অনুসন্ধান করবেন। তবে, ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধিতার প্রভাব যেভাবে দুই দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাতে কি কোনও লাভ হচ্ছে সে-দেশের সাধারণ মানুষের? সবথেকে বড় এই প্রশ্নটিই যেন ডামাডোলে চলে যাচ্ছে সবথেকে আড়ালে।