জীবনের সবকিছুই শিল্প হয়ে ওঠে না। তবু শিল্প যা কিছু তা জীবন সংলগ্ন হয়েই থাকে। জীবনের বিপর্যয়ও তাই-ই শিল্পের মর্যাদা। আপাত ভাবে এ হয়তো খানিকটা নিষ্ঠুর। আপাত ভাবে মনে হতে পারে, এই যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা, যা জীবন উপহার দিয়েছে কাউকে, তা আর একজনের কাছে কীভাবে শিল্প হয়ে উঠতে পারে! তবে, জীবন অনেক কিছু ভুলিয়েই দেয়। যেমন গাজার শিশুমৃত্যু বাকি বিশ্বের কাছে অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শিল্প জীবনের সেই বিপর্যয় ভুলতে দেয় না কিছুতেই।
সে-গানই নাকি সবচেয়ে সুন্দর, যে-সুরে বোনা থাকে আমাদের দুঃখের বয়ান। একান্ত নিজের পরিসরে যে-মুহূর্ত বিপর্যয় ডেকে এনেছে, শিল্পের দুনিয়া তারই ভোল বদলে দেয়। সর্বজনীন আবেদন সেই বিপর্যয়কেই তখন চিনে নেয় শিল্প বলে। যেমনটা ঘটে গেল সেই ফিলিস্তিনি বালকের (Gaza) ক্ষেত্রে। ইজরায়েলি বোমার আঘাতে উড়ে গিয়েছিল যার দুই হাত। অবশ্য প্যালেস্তাইনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এ তো রোজের খবর। নিছক খবর-ই। কেন-না গোটা পৃথিবীই এতদিনে সে খবরের পাতা উলটে অন্য খবরে পৌঁছে যাওয়ার অভ্যাস করে ফেলেছে।
গাজার শিশুরাও (Gaza) এতদিনে জেনেই গিয়েছে, কেবল গাজায় জন্মেছে বলেই তাদের জন্মের সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে বরাবরের অভিশাপ। সে-জন্ম যে কোনও মুহূর্তে ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে কোনও ইজরায়েলি হামলায়। এমনকি সেই না-থাকার খবরও হারিয়ে যেতেই পারে ছিন্নভিন্ন পরিচয়হীন দেহ থেকে। সন্তান হারালেও তার নামটুকু যদি না হারায় অন্তত, সেই আশায় সন্তানদের দেহে নাম লিখে রেখেছিলেন গাজার (Gaza) মা-বাবারা। তবে এমন বিস্মৃতির বয়ানের মধ্যে থেকেই আচমকা পালটে গিয়েছে ন-বছরের মাহমুদ আজৌরের গল্পটা। ভুলে-থাকা গাজা থেকেই পৃথিবীর সামনে ছিটকে এসে পড়েছে তার ছবি, যে-ছবিকে পৃথিবী আর ভুলে যেতে পারেনি। চলতি বছরে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফোটো’ হিসাবে সেরার তকমা জুটেছে সেই ছবিটিরই ভাগ্যে, দু-হাত হারানো বালকের যে ছবিটি তুলেছিলেন চিত্রসাংবাদিক সমর আবু এলুফ।
এই সমস্ত ঘটনাটিই যেন অদ্ভুত এক ‘আয়রনি’। বিধ্বস্ত গাজার (Gaza) দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকা বিশ্ব সেই গাজার ছবিকেই তার দরবারে সাজাচ্ছে, এ ঘটনা যেমন বেমানান; তেমনই ফুটে ওঠার আগেই যে ফুল প্রায় ঝরে গেল হিংস্র রাজনীতির আঘাতে, তার সেই ভয়াবহ দুর্ভাগ্য যে শিল্প হয়ে উঠল অন্য এক দুনিয়ায়, একেই বা কী বলা চলে? অথচ পৃথিবীর শিল্প ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এমন আয়রনি সেখানে ভূরিভূরি। অস্থিরতা যে বরাবরই শিল্প-সাহিত্যের উপাদান হয়ে ওঠে, সে-কথা শিল্পীরা কোনও দিনই অস্বীকার করেননি। মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ হোক কি পিকাসোর ‘গ্যের্নিকা’, সবই তো আদতে সময় ও সমাজের বিপর্যয়ের বয়ানকেই ধরে রেখেছে। অনাহারে ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যুর প্রহর গুনছে এক শিশু, আর তার মৃত্যুর অপেক্ষায় তার সামনে বসে নরমাংসলোভী শকুন, সে ছবিটি কে ভুলতে পারে?
আসলে, জীবনের সবকিছুই শিল্প হয়ে ওঠে না। তবু শিল্প যা কিছু তা জীবন সংলগ্ন হয়েই থাকে। জীবনের বিপর্যয়ও তাই-ই শিল্পের মর্যাদা। আপাত ভাবে এ হয়তো খানিকটা নিষ্ঠুর। আপাত ভাবে মনে হতে পারে, এই যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা, যা জীবন উপহার দিয়েছে কাউকে, তা আর একজনের কাছে কীভাবে শিল্প হয়ে উঠতে পারে! তবে, জীবন অনেক কিছু ভুলিয়েই দেয়। যেমন গাজার শিশুমৃত্যু বাকি বিশ্বের কাছে অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শিল্প জীবনের সেই বিপর্যয় ভুলতে দেয় না কিছুতেই। যেমন, গ্যের্নিকা দেখে আমরা ভুলি না ফ্যাসিস্ট আক্রমণ।
তেমনই গাজার (Gaza) এই বালকের ছবি- যা শিল্প হয়ে উঠেছে, তা দেখেও আমরা ভুলব না যে, কী যন্ত্রণা পাচ্ছিল গাজা, আর তা দখে কেমন নির্লিপ্ত হয়ে ছিল গোটা দুনিয়া। জীবন আর শিল্পের মধ্যে এই চলাচল তাই থেকেই যায়। এ-ছবিও তাই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কাছে যন্ত্রণার স্মারক হয়েই রয়ে যাবে। জীবনের দাম দিয়েই তা কেনা, শিল্পমূল্যেই তা চিরকালীন।
The #WPPh2025 Photo of the Year is ‘Mahmoud Ajjour, Aged Nine’ by @samarabuelouf, for @nytimes. The jury was moved by this portrait of a Palestinian boy which speaks to the devastating long-term costs of war on civilians. Read more: https://t.co/KHmkUjt2Rj pic.twitter.com/QP3lqEBWaR
— World Press Photo (@WorldPressPhoto) April 17, 2025