আরব দুনিয়ায় দীর্ঘদিনের স্বৈরতন্ত্রের বিপক্ষে যখন প্রতিবাদের স্বর জাগতে শুরু করেছিল, তার প্রতি বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের একরকম সমর্থন ছিলই। কিন্তু সেই অভ্যুত্থান কি এক স্বৈরতন্ত্রকে বিনাশ করে আরও বড় বিপদ ডেকে আনল? সিরিয়াতে আইসিসের নতুন করে উত্থানের পরিস্থিতিতে বাকি দুনিয়ার মতো আশঙ্কার প্রহর গুনছে ভারতও।
২০১০ সালের গোড়ায় যে আরব বসন্তের সূত্রপাত, তার ফুল ফুটল চলতি বছরের শীতার্ত ডিসেম্বরেও। তিউনিসিয়া-মিশর-লিবিয়া পেরিয়ে এবার বদল সিরিয়ায়। টানা ১৪ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের পর দেশ ছেড়ে পালালেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। কিন্তু সিরিয়ার অন্দরের এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন ভারতের উপর কতখানি প্রভাব ফেলবে, তা নিয়েই চিন্তা বাড়ছে এ দেশের।
আরব দুনিয়ায় দীর্ঘদিনের স্বৈরতন্ত্রের বিপক্ষে যখন প্রতিবাদের স্বর জাগতে শুরু করেছিল, তার প্রতি বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের একরকম সমর্থন ছিলই। তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপ্লবের ফলে শাসকের পতন ও পলায়নের ঘটনায় গণবিক্ষোভ প্রথমবার আশার আলো দেখেছিল। এরপর বিদ্রোহের জেরে পদত্যাগ করেন মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক। ৩৫ বছরের শাসনের ইতি টানবেন বলে ঘোষণা করেন ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আলি আব্দুল্লাহ সালেহ। বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়ে গদ্দাফির ৪২ বছরের শাসন শেষ হয়। এই পরম্পরাতেই এবার নয়া সংযোজন সিরিয়া। দিল্লি থেকে দামাস্কাসের দূরত্ব অন্তত ৪ হাজার কিলোমিটার হলেও সিরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা চিন্তা বাড়াচ্ছে ভারতের। যে কোনও দেশের যুদ্ধবিগ্রহ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে তো প্রভাব ফেলেই। তবে তা ছাড়াও এই পরিস্থিতিতে ভারতের আশঙ্কা, কাশ্মীরে নতুন করে মাথাচাড়া দিতে পারে জেহাদের বিষবৃক্ষ।
৫০ বছর ধরে সিরিয়ার মসনদে থেকেছে আসাদ পরিবার। ভারত-সিরিয়ার মৈত্রীর সম্পর্ক আসাদ সরকারের আমলেই বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছিল। বাশার আল-আসাদের আমলেই সিরিয়ার উন্নয়নে একাধিক ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ করে ভারত। পাশাপাশি সে দেশে প্রচুর পরিমাণে চাল, ওষুধ ও বস্ত্র রপ্তানিও করা হত। সবচেয়ে বড় কথা, আন্তর্জাতিক মঞ্চে সিরিয়ার সমর্থনও পেয়েছে ভারত। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাশ্মীর ইস্যু।
আসলে ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পর ভারতের পাশেই ছিল সিরিয়ার আসাদ সরকার। রাষ্ট্রসংঘে যখন তুরস্ক পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ভারতের বিরোধিতা করে, সে সময়েও সিরিয়া স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল এটা ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু আসাদের পলায়নের পর সিরিয়ার ক্ষমতা আইসিস-পুষ্ট বিদ্রোহীদের হাতে গেলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত আর এই সমর্থন পাবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। ২০১৪ সালে ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে মিলে কড়া হাতে সন্ত্রাস দমন করেছিলেন আসাদ। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে ফের সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে সে দেশে। আর আরব দুনিয়ার সন্ত্রাস বাকি দুনিয়ার পক্ষেও বিপজ্জনক। হায়াত তেহরির আল সাম নামে সিরিয়ার যে বিদ্রোহী সংগঠন আসাদকে উৎখাত করেছে তারা তুরস্কের সমর্থক, তুরস্কের সাহায্যেই দামাস্কাসের দখল নিয়েছে তারা। তার ফলে ধরেই নেওয়া যায়, কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের সমর্থক তুরস্কের প্রভাব বাড়বে সিরিয়াতে। সুতরাং পাকিস্তানের পাশাপাশি সিরিয়া থেকেও কাশ্মীর ইস্যুতে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা, এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র-টাকার সমর্থন জোগানো আশ্চর্য নয়।
ভারত সরকারের কাছে কাশ্মীর ইস্যু সবসময়েই কাঁটার মতো জেগে থাকে। সেখানে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাশ্মীর ইস্যুতে সমর্থন সরে যাওয়ার আশঙ্কা সরকারের চিন্তা বাড়াবেই। আর কাশ্মীর এলাকায় ফের সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়া আর সেই সূত্রে উপত্যকা ফের অশান্ত হয়ে পড়ার উদ্বেগেও আপাতত কপালে ভাঁজ ভারতের। যে আরব বসন্ত স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তির বার্তা দিয়েছিল, যে বার্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল বাকি বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের ভিড়, সেই অভ্যুত্থান কি এক স্বৈরতন্ত্রকে বিনাশ করে আরও বড় বিপদ ডেকে আনল? যে সন্ত্রাসের জ্বালায় গোটা পৃথিবী অস্থির, তাতেই কি নতুন করে ঘি ঢালবে সিরিয়া? সিরিয়াতে আইসিসের নতুন করে উত্থানের পরিস্থিতিতে তাই বাকি দুনিয়ার মতো আশঙ্কার প্রহর গুনছে ভারতও।