নির্বাচনী বন্ডের হাতেগরম খবরে ভোটের বাজারের হাওয়া আরও গরম। একদিকে শাসক দলের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগে সুর চড়াচ্ছে বিরোধীরা, অন্যদিকে আমজনতার প্রশ্ন, ভোটাভুটি কি সত্যি আর কাউকে নির্বাচন কিংবা খারিজ করছে?ভোটের আগে রাজনৈতিক লেনদেনের ছবি ফাঁস করে বন্ড-ই আপাতত জেমস বন্ডের ভূমিকায়।
লোকসভা ভোটের আগেই রাজনৈতিক চাঁদা নিয়ে সরগরম মিডিয়া থেকে সোশাল মিডিয়া। নির্বাচনী বন্ডের হাতেগরম খবরে ভোটের বাজারের হাওয়া আরও গরম। নাম গোপন করে রাজনৈতিক দলগুলিকে যেভাবে বিপুল চাঁদা দিয়েছে একাধিক সংস্থা, তা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়েই। যে বন্ড ব্যবস্থাকে খোদ শীর্ষ আদালত অসাংবিধানিক বলে চিহ্নিত করেছে, ভোট প্রক্রিয়াকে তা কীভাবে প্রভাবিত করছে বুঝতে চাইছেন আমজনতাও। সব মিলিয়ে ভোটের বাজারে বন্ড-বাদ্যের শোরগোল।
আরও শুনুন:
CAA নিয়ে আপত্তি থাকা উচিত নয় দেশের মুসলিমদেরও, কেন উঠছে এমন মত?
কদিন আগেই কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান নেতা আক্ষেপের সুরে বলেছেন, ভোটের প্রচার করবেন কী, টাকাই তো নেই। ভোটের আগেই ১০৫ কোটি টাকা আয়কর মেটানোর নির্দেশে কংগ্রেস যে বড় ধাক্কা খেয়েছে, তাও দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। সুতরাং এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভোট লড়তে টাকা লাগে। একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর জন্য, কিংবা ভোটার বাড়ানোর জন্য টাকা ছড়ায় রাজনৈতিক দলগুলি। আর সেই টাকার জন্য তাদের অনেকখানিই নির্ভর থাকে চাঁদার উপর। আমার আপনার চাঁদা নয়, বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনুদান। এমনিতে নির্বাচনে অনুদান অবশ্য নতুন কিছু নয়। তা আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে মোদি সরকার যখন নির্বাচনী বন্ড চালু করে, তখন এর মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল সেই অনুদানের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা। অর্থাৎ নগদে চাঁদা নেওয়া যাতে বন্ধ হয়, এবং অনুদানের নামে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া যেন না চলে। বন্ডের মাধ্যমে অনুদানের শর্ত ছিল যে, যে চাঁদা দিচ্ছে আর যাকে চাঁদা দেওয়া হচ্ছে তা গোপন থাকবে, সেই সঙ্গে গোপনীয়তা রক্ষিত হবে চাঁদার অঙ্কেও। কিন্তু সাম্প্রতিক সুপ্রিম রায়ের মোদ্দা কথা এটাই যে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে দেওয়া অনুদানের ভিত্তিতে আসলে নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেই যথেচ্ছ প্রভাব বিস্তার করতে পারছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যে বিশ্বাস ও ভিত্তি থেকে একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দিচ্ছে এবং শাসকের ভূমিকায় আসীন করছে, সেই বিশ্বাসেরই হানি হচ্ছে। কেননা যে কর্পোরেট চাঁদা দিচ্ছে, তার মন রক্ষা করতে গিয়ে, জনস্বার্থ যে বিঘ্নিত হতে পারে, এ খুব সহজ সমীকরণ। প্রায় সাত দশক আগে চার্চিল বলেছিলেন, গণতন্ত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই ছোট্ট মানুষটি, যে একটি ছোট্ট বুথে গিয়ে একটি ছোট্ট পেনসিল নিয়ে একটি ছোট্ট কাগজে ঢ্যাঁড়া দেয়। গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিয়ে যত তর্কবিতর্ক, আলাপ আলোচনাই হোক না কেন, তা ওই ছোট্ট মানুষটির গুরুত্বকে লঘু করে দিতে পারে না, এমনটাই বলতে চেয়েছিলেন তিনি। বর্তমান সময়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া সেই আম মানুষকে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় উসকে উঠেছে বারে বারেই। কিন্তু এই নির্বাচনী বন্ড ইস্যু বোধহয় সেই সংশয়ে একরকম শিলমোহরই ফেলে দিল।
আরও শুনুন:
রাষ্ট্রকে প্রশ্ন নয়! গণতন্ত্র চলছে?
সুপ্রিম নির্দেশে এসবিআই কমিশনকে যে তথ্য জানিয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রথম ৩০টি ক্রেতা সংস্থার ১৪টিতেই কখনও না কখনও আর্থিক কারণে তল্লাশি চালিয়েছে সিবিআই, ইডি কিংবা আয়কর দপ্তর। যেমন, মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সংস্থার একাধিক অফিসে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে হানা দেয় আয়কর দপ্তর। হলদিয়া এনার্জিতে ২০২০ সালের মার্চ মাসে হানা দেয় সিবিআই। ২০২২ সালের অগস্ট মাসে বেদান্ত লিমিটেডে তল্লাশি চালায় ইডি। বন্ড কেনায় শীর্ষে রয়েছে বিতর্কিত লটারি ব্যবসায়ী মার্টিন সান্তিয়াগোর সংস্থা ‘ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস’, ২০১৯ সাল থেকেই যার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে ইডি। আবার ৯৬৬ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনা মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং একাধিক সরকারি প্রকল্পের বরাত পেয়েছে। এমনই একাধিক সংস্থার নাম তুলে ধরে ঘুষের অভিযোগে সরব হয়েছে কংগ্রেস। এমনিতেই হিসাব বলছে, ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে বিজেপিরই। এই অবস্থায় বিজেপির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে ‘হপ্তা উসুল’ অর্থাৎ ‘তোলাবাজি’র অভিযোগ তুলে আক্রমণ শানাচ্ছে বিরোধীরা। সত্যি বলতে, যাদের নাম বড় দুর্নীতিতে জড়িয়ে, কিংবা রকেটের গতিতে শিল্পমহলে উত্থান হয়েছে যাদের, তেমন ব্যবসায়ীদের নাম ক্রেতা তালিকার উপরদিকে দেখে প্রশ্ন উঠছে আমজনতার মনেও। এই একটি ইস্যুতে যেভাবে রাজনৈতিক লেনদেনের ছবি ফাঁস হয়ে গিয়েছে, তাতে বলাই বাহুল্য, ভোটের বাজারে বন্ড-ই এখন জেমস বন্ড।