মনপসন্দ খাবার চাই, অ্যাপে অর্ডার করলেই তাঁরা এসে বাড়ির দরজায় দিয়ে যান। তাও আবার বাঁধা সময়ের মধ্যে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে বিলাসের সামগ্রী, সবই আজকাল অনলাইনে কেনাকাটায় আমরা অভ্যস্ত। আর সেই সার্ভিস সেক্টরে যাঁরা দিনরাত পরিশ্রম করেন, তাঁরাই নতুন যুগের শ্রমিক। ‘গিগ ইকনমি’ তাঁদের শ্রমিক বানিয়েছে বটে, কিন্তু দেয়নি সুযোগ-সুবিধা। অথচ এই শ্রমিকরা তো আমাদেরই আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশী। ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তাঁদের ভাগ্য? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
তাঁরা নতুন যুগের রানার। পিঠে খাবার আর জিনিসের বোঝা নিয়ে চরকিপাক খাচ্ছেন শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। স্বাভাবিক ভাবেই, সেই সব জিনিসে তাঁদের অধিকার নেই। অধিকার থাকার কথাও নয়। কিন্তু যে অধিকার তাঁদের প্রাপ্য, এমনকী শ্রমিকের সুবিধা বা মর্যাদা- তা-ও কি তাঁরা পাচ্ছেন? তথ্য বলছে, মোটেও না। নতুন যুগের শ্রমিকরা কবে যে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পাবেন, সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট দিশা দেখা যাচ্ছে না।
আরও শুনুন: ভারতের জন্য বদল ‘ওপেনহাইমারে’র নগ্ন দৃশ্যে! খাজুরাহোর দেশেই ছুঁতমার্গ কেন, উঠছে প্রশ্ন
অথচ তথ্য বলছে, এ দেশের মোট যে শ্রমশক্তি, তার ৯০ শতাংশই আসছে এই গোত্রের শ্রমিকদের থেকে। আটের দশকের শেষ থেকে শুরু করে নয়ের দশকের গোড়া থেকেই দেশের শ্রমিকের একরৈখিক ধারণায় বিরাট বদল এসেছে। প্রসারিত হয়েছে অসংগঠিত শ্রমের ক্ষেত্র। বেড়েছে অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যাও। যত দিন গড়িয়েছে, তাঁদের কোনও এক ছাতার তলায় আনা ততই দুরূহ হয়েছে। ফলত চিরাচরিত শ্রমিক আন্দোলনের পদ্ধতিগুলোও পথ হারিয়েছে। আর সেই ফাঁক দিয়েই ক্রমশ বেড়েছে অধিকার চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা। সংগঠিত শিল্প বলতে আমরা বুঝি, শ্রমিক আইন অনুযায়ী যেসব উৎপাদন প্রক্রিয়া কলকারখানা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে, অর্থাৎ যেসব শিল্পে একই ছাদের তলায় বা সংস্থায় কমপক্ষে ১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। দশ জন শ্রমিকের সংখ্যাটি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ অধিকাংশ শ্রম আইনই প্রযোজ্য এমন সংগঠিত সংস্থার ক্ষেত্রে, যেখানে শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত দশ জন। এই হিসেবে ভারতবর্ষের শ্রমজীবী মানুষের কেবলমাত্র ৫-৬ শতাংশ সংগঠিত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। ভারতবর্ষের শ্রমজীবী মানুষের প্রায় শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ অসংগঠিত শ্রমিক, যাঁদের প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে দেখতে পাওয়া যায়।
অসংগঠিত শ্রমিকের হাতেই রয়েছে দেশের কাজকর্মের একটা বড় অংশ। ২০২২ সালে নীতি আয়োগের পরিসংখ্যান জানিয়েছিল, তার আগের অর্থবর্ষে এ দেশে অন্তত ৭৭ লক্ষ মানুষ ‘গিগ-শ্রমিক’ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। ২০২৯-৩০ অর্থবর্ষে সেই সংখ্যাটা প্রায় আড়াই কোটিতে পৌঁছবে বলেই ধারণা। সার্ভিস সেক্টরের সমস্ত চাহিদাই মেটাচ্ছেন এই শ্রমিকরা। কিন্তু দায়িত্ব যতখানি, সুবিধা কি আদৌ তাঁরা পাচ্ছেন? সোজা কথায়, না। এই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কোনও শ্রমিককে যে পরিমাণ শ্রম দিতে হয়, তার বিনিময়ে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা মেলে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। বিশেষ করে গিগ-শ্রমিকদের অবস্থা আরও খারাপ বই ভাল কিছু নয়। তাঁদের অনেকেরই না আছে নিয়োগপত্র, না আছে ভবিষ্যতের দিশা। কাজের সময় বা রোজগার কোনোটিই নিশ্চিত নয়। পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, মেডিক্লেম- কোনও কিছুই নেই এই শ্রমিকদের। সোজা কথায়, যাঁরা শ্রম দিচ্ছেন, তাঁরা শ্রমিক কি-না তাই-ই আদৌ স্পষ্ট নয়। অতএব সুযোগ-সুবিধাও বিশ বাঁও জলে।
আরও শুনুন: মুসলিম বাসিন্দা নেই একজনও, তবু সমারোহে মহরম পালন কর্ণাটকের গ্রামে
তবে সম্প্রতি সংসদের এক প্যানেল কেন্দ্রের শ্রম মন্ত্রককে নির্দেশ দিয়েছে, গিগ শ্রমিক এবং অ্যাপ-কর্মীদের জন্য দ্রুত কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করতে হবে। এর আগেই দেশের ৪৪টি শ্রম আইনকে খানিকটা এক জায়গায় এনে ও অনেকটা সরল করে চার শ্রম কোড পাশ হয়েছে সংসদে। কিন্তু এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের বক্তব্য, এই আইন অনুযায়ী সামাজিক সুরক্ষার আওতায় পড়বেন গিগ শ্রমিকেরাও। আইনের চারটি বিধি হল, বেতন সংক্রান্ত বিধি, শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধি, শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধি এবং শিল্প-সম্পর্ক সংক্রান্ত বিধি। সম্প্রতি এই গোত্রের শ্রমিকদের ন্যূনতম সুবিধা পাওয়া নিয়ে ফের আলোচনা হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রূপায়ণে কোনও কোনও বিষয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
অর্থাৎ, এই যে নতুন যুগের শ্রমিকরা, তাঁরা কবে শ্রমিকের মর্যাদা ও সুবিধা পাবেন তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। প্রথাগত চাকরির ক্ষেত্র ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। সেই সংকট থেকে বহু তরুণ এই পরিষেবা-নির্ভর কাজ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। রুটি-রুজি উপার্জনের জন্য প্রাণপাত করছেন। তাঁদের পৌঁছে দেওয়া পরিষেবা গ্রহণ করছে নাগরিক বৃত্ত। কিন্তু সেই বৃত্তেই ঘোরাফেরা করা অসংখ্য শ্রমিকের কথা কি একবারও ভাবছে উপরতলার মানুষ? প্রদীপের নিচে জমে থাকা অন্ধকারের মতোই এ প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।