নোনা দেওয়াল থেকে যিশু এখনও ছলছলে চোখে তাকিয়ে আছেন কি? জানে না বেথলেহেম। তবে যুদ্ধের আগুনে পুড়ে যাওয়া শহরে যে তিনিও আশ্বাস দিতে ভুলে গিয়েছেন, তা মনে মনে জেনে গিয়েছেন শহরের বাসিন্দারা। আলো নয়, আঁধার মেখেই তাই এবার বড়দিন এসেছে যিশুর ঘরে। সেই বিষণ্ণ বড়দিনের গল্প শোনালেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
এ শহর জুড়ে এখন হা হা শূন্যতা। আনন্দ থেকে, খুশি থেকে, উৎসব থেকে অনেক দূরে, এক দম বন্ধ করা শূন্যতার মধ্যে প্রহর গুনছে এ শহর। বড়দিনের উপহার দিতে সান্তা এ শহরে উঁকি মেরেছিলেন কি না জানা যায়নি, কিন্তু সে উপহার নেওয়ার মতো শিশুদের অনেক আগেই কবরে শুইয়ে এসেছে শহর। আর যদি বা কোথাও কোনও প্রাণ রয়ে গিয়েছে এখনও, তাদের ছেঁড়া মোজায় খেলনা রেখে আসতে হয়তো হাত কেঁপে গিয়েছে বৃদ্ধ সান্তা ক্লজেরও। তিনিও তো জানেন, খেলনা নয়, এখন বুলেটপ্রুফ জামা ছাড়া ওই শিশুদের আর কিছু দেওয়ার নেই তাঁর। আর যুদ্ধের আগুনে পুড়তে থাকা সেই গাজার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গিয়েছে পড়শি শহর বেথলেহেমও। যুদ্ধের আঁচে পুড়ছে বেথলেহেম নিজেও। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন, যিশুর জন্মস্থান নাকি এখানেই। অথচ যিশুর জন্মদিনে সেই ঘরই এবার আঁধারে ঢাকা। যিশুর ঘরে এবার বড়দিন এসেছে, কিন্তু উৎসব আসেনি। লাগাতার বোমাবর্ষণ, রকেট হামলায় যে শিশুরা নিমেষে নাম হারিয়ে কেবল এক-একটা সংখ্যা হয়ে গিয়েছিল, যিশুর মুখের সঙ্গেই একাকার হয়ে গিয়েছে তাদের থাকা-টুকু। তাই ক্রিসমাস ট্রির বদলে এবার অন্য একরকম সাজ বেথলেহেমের। অন্যান্য বছরে এই মরশুমে সে শহরে ভিড় জমান দেশবিদেশের পর্যটকেরা। ম্যাঙ্গার স্কোয়ার সেজে ওঠে আলোয় আলোয়। ক্রিসমাস ক্যারল, ব্যান্ডের বাজনা, কেক আর ওয়াইনে উৎসবের ভিড় উপচে পড়ে। সেই উৎসবের চত্বর এবার গোটা প্যালেস্টাইনের মতোই শূন্য, ধূসর। বড় বড় পাথরের চাঁইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে কেবল দুয়েকটি মূর্তি, আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা। নারীমূর্তিদের পরনে বোরখা, মুখে হিজাব। আর তাদেরই একজনের হাতে সাদা কাপড়ে জড়ানো এক শিশুর মৃতদেহ। গাজায় অসংখ্য শিশুহত্যার প্রতিবাদ বুকে নিয়ে যিশুর জন্মভূমিতে স্থির হয়ে আছে এই ছবি। ছোটদের হাতে থাকা সান্তা ক্লজের বেলুনেও লেখা, “গাজায় যুদ্ধবিরতি চায় বেথলেহেমের ক্রিসমাস বেল।’’
আরও শুনুন: জল পর্যন্ত নেই, মুঠো মুঠো ওষুধ খেয়ে পিরিয়ডস পিছোতে মরিয়া গাজার মহিলারা
ক্রুশে বিদ্ধ হতে হতেও ক্ষমার কথা শুনিয়েছিলেন যিশু। বলেছিলেন ভালোবাসার কথা। বড়দিনে সেই শান্তি আর ভালোবাসার বার্তাকেই বুকের মধ্যে জারিয়ে নেন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানেরা। যেমনটা এতদিন ধরে করে এসেছে বেথলেহেম। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত প্যালেস্টাইনে আর সে কথা বলতে পারছে না যিশুর শহর। এবার বড়দিনে তাই শহর জোড়া কেবল দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ আর বিষণ্ণতার কথাই।
ক্ষোভ, রাষ্ট্রের প্রতি। ক্ষোভ, ক্ষমতার প্রতি। পরিকল্পনা করেই শিশুদের আঘাত করা হচ্ছে, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে এমন কথাও শোনা গিয়েছে যে। মনে পড়ে, যিশুর জন্মের পর ইহুদিদের নতুন রাজা এসেছে এই ভবিষ্যদ্বাণী শুনে ভয় ধরেছিল রাজার। তাই বেথলেহেম আর তার আশেপাশের সব এলাকার দুবছরের কম বয়সি যত শিশু, সকলকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন রাজা। এই ঘটনাকে ‘ম্যাসাকার অফ ইনোসেন্টস’ বলে থাকেন গবেষকেরা। হাজার হাজার বছর পেরিয়ে সেই ভূমিতেই ফের আঘাত নেমেছে শিশুদের উপর। বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শিশুদের অনেককে আর আলাদা করে চেনার উপায়টুকু পর্যন্ত ছিল না। গণকবরে একের পর এক ঠাঁই হয়েছে সেইসব নিহত শিশুর। এমনকি, মৃত্যুর পর যাতে শনাক্তকরণটুকু অন্তত সম্ভব হয়, এমনই এক দুরাশায় সন্তানদের শরীরে তাদের নাম লিখে রাখতে শুরু করেছিলেন গাজার মানুষ। রাজনীতি আর রাষ্ট্রনীতির যুদ্ধে যাদের সব অস্তিত্ব মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন, তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মর্মান্তিক অসহায়তায় বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, স্রেফ সংখ্যা নয়, ওরাও মানুষ। তবে কেবল রাজনীতির মুখেরা কেন, গোটা পৃথিবীও এত মৃত্যু আর এত রক্ত নিয়ে তেমন সরব হল কই! হয়তো ধর্ম, হয়তো বর্ণ, হয়তো রাজনীতি- কিংবা হয়তো একযোগে সব বিষয় দিয়েই এই মুহূর্তে নির্ধারিত হচ্ছে প্রতিবাদ। সেই নির্মিত নীরবতার সামনে দাঁড়িয়ে কেবল ক্ষোভ জমিয়ে রাখা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে আমজনতার!
তাই শেষমেশ সেই ক্ষোভ হয়তো দানা বাঁধে ঈশ্বরের প্রতিও। “তোমার আমার ভয় গো জাগে/ তোমার আমার ভয়/ রাতবিরেতে দেওয়ালে পিঠ, কষ্ট বিনিময়/… তবু যুদ্ধ কেন হয় গো যিশু, যুদ্ধ কেন হয়?” – বেথলেহেমের মানুষেরা ‘সোফিয়া’ নামের এ গানের কথা জানেন না। তবে এ গানের মতো তাঁরাও জানেন, স্বয়ং যিশুকেই যেখানে বিদ্ধ হতে হয়, সেখানে যিশুর কাছেও এ প্রশ্নের উত্তর নেই কোনও। যুদ্ধের হুংকারে যেখানে মানুষের বেঁচে থাকাটুকুই বড় সংকটে, মানবপুত্রের দেখা সেখানে মিলবে কীভাবে? বড় অন্ধকার আর বেদনা সঙ্গে নিয়েই তাই এবার বড়দিন এসেছে বেথলেহেম শহরে।