মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা! এত দ্রুত সবকিছু ঘটে গিয়েছিল যে ঘটনার আকস্মিকতায় গোড়াতে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। তবে অভিজ্ঞতার দরুন ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে দেরি হয়নি তাঁর। এক লহমাতেই বুঝতে পেরেছিলেন, মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। অভিশপ্ত সেই রাতের স্মৃতি এখনও তাড়া করছে হুগলির উত্তরপাড়ার বাসিন্দা দেবাশিস দত্ত ও বনশ্রী দত্তকে। শুনলেন, শুভদীপ রায়।
ঘটনার পর পেরিয়ে গিয়েছে ৩৬ ঘণ্টার বেশি। তবু কথা বলতে গেলে এখনও গলা কেঁপে উঠছে তাঁদের। অভিশপ্ত সেই রাতের স্মৃতি ফিরলে এখনও যেন তাড়া করছে আতঙ্ক। বেঁচে যে ফিরতে পারবেন তা হয়তো সেই অন্ধকার মুহূর্তে প্রথমে ভেবেই উঠতে পারেননি উত্তরপাড়ার বাসিন্দা দেবাশিস দত্ত ও তাঁর স্ত্রী বনশ্রী দত্ত। অভিশপ্ত ট্রেন থেকে বেঁচে ফেরাই যেন এখন ‘অলৌকিক’ বলেই মনে হচ্ছে তাঁদের।
ছেলে থাকে চেন্নাইয়ে। সেখানেই যাচ্ছিলেন স্বামী-স্ত্রী। সাঁতরাগাছি থেকে ধরেছিলেন ১২৮৪১ করমণ্ডল এক্সপ্রেস। সব ঠিকঠাকই চলছিল। দুজনের জন্য বরাদ্দ ছিল লোয়ার বার্থ। নিজের বার্থে শুয়ে পড়েছিলেন দেবাশিসবাবু। আর পাশের বার্থে তখনও বসে ছিলেন তাঁর স্ত্রী। হঠাৎই যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটা তখন সাতটা ছুঁইছুঁই কিংবা সবে সাতটা পেরিয়েছে। তীব্র একটা ঝাঁকুনিতে মুহূর্তে থমকে গেল ট্রেনের গতি। ঝাঁকুনির তীব্রতা এতখানি যে গোটা কামরাটাই তখন উপর-নিচে দুলছে। মনে হচ্ছে যেন বিরাট শক্তিধর কোনও ব্যক্তি ট্রেনের কামরাটাকে খেলনা ভেবে দোলাচ্ছে। বাইরে তখন পচণ্ড আওয়াজ। যেন পরপর বিস্ফোরণ ঘটেছে। জোরালো সেই আওয়াজে এলাকার নিস্তব্ধতা খানখান। চাপা পড়ে যাচ্ছে আর্ত চিৎকারও। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা! এত দ্রুত সবকিছু ঘটে গিয়েছিল যে ঘটনার আকস্মিকতায় গোড়াতে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন দেবাশিসবাবু। তবে অভিজ্ঞতার দরুন ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে দেরি হয়নি তাঁর। এক লহমাতেই বুঝতে পেরেছিলেন, মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
তখন মাথায় ঘুরছে শুধু একটাই কথা। এই পরিস্থিতি থেকে কোনোভাবে বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। কামরা থেকে বাইরে না বেরোতে পারলে বাঁচার উপায় নেই। কোনক্রমে বার্থ থেকে বাঙ্ক ধরে ওঠার চেষ্টা করলে বুঝতে পারেন, যেভাবে কামরাটা দুলছে তাতে ওঠাই যাবে না, বেরনো তো দূরের কথা। তীব্র ভয় আর আতঙ্ক তখন ছড়িয়ে পড়েছে কামরার অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যেও। আতঙ্কে কাঁটা দেবাশিসবাবুর স্ত্রী বনশ্রীদেবীও। সেই অবস্থাতে নিজেকে সামলে কোনক্রমে উঠে দাঁড়ান দেবাশিসবাবু। জানলার বাইরে চোখ রেখে দেখতে পান আগুনের ঝলকানি। ট্রেনটি যে আর লাইনের উপর নেই তা তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। ট্রেনের চাকাগুলো লাইন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেই ঘর্ষণের দরুনই ভীষণ আওয়াজ আর আগুনের দাপাদাপি। কামরার আলোও তখন নিভে গিয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে শুধুই আতঙ্ক আর চিৎকার। চাকরিসূত্রে রেলের সঙ্গে আগে যুক্ত ছিলেন দেবাশিসবাবু। ফলত এ ঘটনার লক্ষ্মণ দেখেই বুঝতে পারেন, দারুণ গতিতে ছুটে চলা এক্সপ্রেসটি লাইনচ্যুত হয়েছে। তাঁরা ছিলেন একেবারে শেষের দিকের একটি কামরায়। সেখানেই যে আঁচ এসে পড়েছে, তাতে অবস্থা যে কতটা ভয়াবহ তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। তবে ঠিক কতগুলো বগি লাইনচ্যুত হয়েছে, কতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে সে সব তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। লক্ষ্য ছিল একটাই, অন্ধকারের মধ্যে ওই অভিশপ্ত কামরা থেকে বেরিয়ে আসা।
জীবন-মৃত্যুর সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ঠিক করেন আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সব শেষ। প্রথমে তাই কামরার ডান দিক দিয়ে বেরনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সে রাস্তা তক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অতএব বাঁ দিক থেকে রাস্তা খুঁজে কোনক্রমে ট্রেনের কামরা থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। কামরা তখন অবশ্য আর লাইনের উপর দাঁড়িয়ে নেই। পড়ে আছে বোল্ডারের উপরে। শুধু পুরোপুরি যে উলটে যায়নি এই রক্ষে। অন্ধকারের মধ্যে নিজের স্ত্রীকে তো বের করে আনেনই। কামরায় ছিলেন দুই বাংলাদেশি মহিলা। চিকিৎসার জন্য তাঁরাও চেন্নাই যাচ্ছিলেন। তাঁদেরকেও অভিশপ্ত ট্রেনের কামরা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেন দেবাশিসবাবু। কামরা থেকে বেরিয়ে প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। রাস্তা বলে কোথাও কিছু নেই। থাকার কথাও নয়। পাশেই এক শুকনো নয়ানজুলি। এমনকী রেল গেটে পর্যন্ত ভেঙেচুরে পড়ে আছে। ওরই মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। দূর থেকে দেখতে পান আশপাশ থেকে মানুষ আসতে শুরু করেছেন। তাঁরা স্থানীয় মানুষ। বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে আন্দাজ করেই মোবাইল জ্বালিয়ে তাঁরা এসেছেন উদ্ধারকাজে। তাঁদের থেকেই একটা রাস্তার হদিশ পান। অন্ধকারে বেশ কিছুটা হাঁটার পর সেই রাস্তা ধরেই বেরিয়ে আসেন দেবাশিসবাবু ও তাঁর সঙ্গীরা। পিছনে তখন অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। চিৎকার আর হাহাকারে বুঝতে পারছেন এক বিভীষিকা থেকে কোনক্রমে প্রাণে বেঁচেছেন তাঁরা।
সেই রাতে কোনক্রমে বাস ধরে কলকাতায় ফেরার সুযোগ হয়। ততক্ষণে সারা দেশ জেনে গিয়েছে কী মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। দেবাশিসবাবুরাও জেনেছেন। মৃত্যু আর ধ্বংসস্তূপ দেখেছেন সংবাদমাধ্যমে। আর ভেবেছেন, ঠিক এখানেই তো ছিলেন তাঁরা। এই ধ্বংসলীলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা একেবারেই সহজ ছিল না। থেকে থেকেই এখনও মনের মধ্যে হানা দিচ্ছে সেই তীব্র ঝাঁকুনি। জানলার বাইরে আগুনের ঝলকানি। রেলের চাকার ঘর্ষণে সেই বিস্ফোরণের মতো বীভৎস শব্দ। ঘটনার পর গোটা একটা দিন পেরিয়েও যেন বিভীষিকা পিছু ছাড়ছে না তাঁদের। তাঁরা জানেন, অনেকেরই ঘরে ফেরার কথা ছিল। ফিরতে পারেননি প্রায় কেউই। এত মৃত্যুর ভিতর তবু তো তাঁরা প্রায় সুস্থ ভাবেই ঘরে ফিরতে পেরেছেন। জীবন যেন আসলে অলৌকিক! একটা দুর্ঘটনা আর তার অভিশপ্ত স্মৃতি বারেবারেই যেন সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রৌঢ় দম্পতিকে।