এই অস্থির সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও সংকটের আশঙ্কা৷ সেখানে যে ইউনুস গ্রামীণ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বহু মানুষের দারিদ্র্য দূর করেছিলেন, তিনি দায়িত্ব পেলে দেশের কঠিন সময়ে আর্থিক মোকাবিলা করা সহজ হবে বলে মনে করাটাই স্বাভাবিক৷ তাহলে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর মহম্মদ ইউনুস কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন? পড়শি দেশের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখলেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সোমবার দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বাংলাদেশে শান্তি আসেনি৷ বরং সেখানে এক চরম বিশৃঙ্খলা এবং লুঠতরাজ চলতে দেখা যাচ্ছে৷ হাসিনার দেশত্যাগের পরেই আপাতত বাংলাদেশ সেনার দখলে৷ ইতিমধ্যে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সাংবাদিক সম্মেলন করে দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গড়া হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আরও শুনুন:
ভাঙল মূর্তি, বঙ্গবন্ধুর হিন্দু-মুসলিমকে রক্ষার কর্তব্য মনে রাখবে তো ‘নতুন’ বাংলাদেশ?
পালাবদলের এই আন্দোলনে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে ছাত্রদের৷ এই আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল কোটা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে, যা পরবর্তীকালে একেবারে ব্যক্তিগত ভাবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পরিণত হয়৷ অস্বীকার করার উপায় নেই, এই আন্দোলন এই পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছে শুধুমাত্র বহু ছাত্রের আত্মবলিদানের মাধ্যমে৷ সেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর শীর্ষ সারিতে থাকা ছাত্র নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা তথা নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুসকে চাইছেন৷ এই আর্জি নিয়ে একটি ভিডিও বার্তা ছাত্রদের পক্ষ থেকে পাঠানোর পাশাপাশি ইউনুসের সঙ্গে তাঁদের এই বিষয়ে কথাও হয়৷ নোবেলজয়ী এই বঙ্গসন্তান ‘ছাত্রদের আহ্বানে এবং বাংলাদেশকে রক্ষায়’ দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে৷
২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সাফল্যের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পান মহম্মদ ইউনুস। অর্থনীতির এই অধ্যাপক তাঁর মডেল ব্যাঙ্কটিকে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য দূর করার জন্য প্রয়োগ করেন৷ ব্যাঙ্কটি বাংলাদেশের গ্রামের মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য ক্ষুদ্র ঋণ (দুহাজার টাকা) প্রদানের উপর নজর দেয়, যাতে তাঁরা হাঁস-মুরগি পালন, তাঁত চালানো বা পণ্য বিক্রি করতে পারেন। জামানত ছাড়াই ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা হয় ৷ সে ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছিল বিশ্বাসের ভিত্তিতে, এবং কয়েকজন মহিলাদের নিয়ে গঠিত ছোট ছোট গোষ্ঠীর সদস্যদের একে অপরের দায়ের নির্ভরতার উপর ভর করে। এই পদ্ধতি লক্ষাধিক মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে সাহায্য করে এবং মহম্মদ ইউনুস ‘ব্যাঙ্কার টু দ্য পুওর’ বলে পরিচিতি লাভ করেন৷ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের এই মডেলটি বিশ্বব্যাপী শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়ে৷
আরও শুনুন:
মুজিবের মুক্তির ডাকে উদ্বেল, চায়ের আড্ডায় বসেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লিখলেন গৌরীপ্রসন্ন
তবে তাঁর এই কর্মকাণ্ড নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন তুলে উলটে ইউনুসকে কাঠগড়ায় তুলতে দেখা যায় শেখ হাসিনার সরকারকে৷ মহম্মদ ইউনুস মাইক্রোফিনান্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ঋণ দিয়ে তাঁদের নিজস্ব রোজগারের মাধ্যমে স্বনির্ভর করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলেন৷ আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে হলেও হাসিনার চোখে এই কর্মকাণ্ড ছিল গরিবের পাশে দাঁড়ানোর বদলে উচ্চহারে সুদ নিয়ে গরিবদের রক্ত চোষা। এই ধরনের ঋণে সুদের হার রীতিমতো বেশি, সুদ আদায়ের জন্য বলপ্রয়োগও করা হয় এবং এমন পরিস্থিতি হয় যে ঋণজাল থেকে সাধারণ মানুষের বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে যায়- এহেন নানা অভিযোগ করা হয়েছিল। ইউনুসের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করে কার্যত তাঁকে আইনের প্যাঁচে জড়িয়ে ফেলেছিল হাসিনা সরকার ৷
ইউনুস এবং তাঁর গ্রামীণ টেলিকমের তিন সহকর্মী মিলে বেশ কয়েকটি সংস্থা গড়ে তোলেন। তার মধ্যে একটি সংস্থা শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে নোবেলজয়ী ইউনুসের বিরুদ্ধে মামলা হয়৷ হাসিনা-ইউনুস বিবাদের বিষয়টা বাংলাদেশের অর্থনীতি থেকে ক্রমশ যেন রাজনীতির আঙিনায় সরে যেতে দেখা গিয়েছিল৷ ইউনুস যেন হয়ে ওঠেন হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বী৷ তবে শেখ হাসিনা যতই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলুন না কেন, আন্তর্জাতিক মহলে সহানুভূতি কুড়িয়ে নিয়েছিলেন ইউনুস৷ নোবেলজয়ী প্রফেসর মহম্মদ ইউনুসের উপর হেনস্তা বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছিলেন বিশ্বের তাবড় ব্যক্তিত্বরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, প্রাক্তন মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট হিলারি ক্লিন্টন, ভারজিন গ্রুপ ফাউন্ডার রিচার্ড ব্র্যানসন প্রমুখ। ওই চিঠিতে তাঁরা আর্জি জানিয়েছিলেন, নোবেল পুরস্কার প্রাপকের উপর বিচারবিভাগের নাম করে হেনস্তা বন্ধ করা হোক।
আরও শুনুন:
হাসিনার পরিণতি আগেভাগেই জানিয়েছিলেন, সোশাল মিডিয়ায় দাবি জ্যোতিষীর
বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতার প্রেক্ষিতে ইউনুসের অভিমত, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে তার প্রভাব গিয়ে পড়বে প্রতিবেশী মায়ানমার ও ভারতেও৷ সেক্ষেত্রে ভারতের উত্তর-পূর্বের ৭ রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গকে সে চাপ সহ্য করতে হবে বলে অনুমান করা যায়। এই অস্থির সময়ে অবশ্যই দেশের অর্থনীতিও বেশ কিছুটা সংকটে৷ সেখানে যিনি গ্রামীণ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বহু মানুষের দারিদ্র্য দূর করেছিলেন, তিনি দায়িত্ব পেলে দেশের কঠিন সময়ে আর্থিক মোকাবিলা করা সহজ হবে বলে মনে করাটাই স্বাভাবিক৷ তা ছাড়া ওপার বাংলার ইউনুসের নোবেল পাওয়ার পর এপার বাংলার মানুষদেরও সেই আনন্দের আবেগে ভাসতে দেখা গিয়েছিল৷ পুরস্কার পাওয়ার পর ইউনুস ভারতে এসেছিলেন, বিভিন্ন সংস্থা বা সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে সেবার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল৷ সেক্ষেত্রে ইউনুস বাংলাদেশের দায়িত্ব যদি পান, তবে সেটা কি দু-দেশের সম্পর্কের পক্ষে শুভ হবে? সেই উত্তর অবশ্য সময়ই বলতে পারবে৷