আন্দোলনের বাংলাদেশে আক্রমণের মুখে বঙ্গবন্ধুও। অথচ দেশকে একদিন আন্দোলনের দিশা দেখিয়েছিলেন তিনিই। সেই সময়েই তাঁকে নিয়ে গান বাঁধা হয়েছিল এপার বাংলাতেও। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
যে বাংলাদেশে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি, সেই দেশ একদিন আন্দোলনের পথে স্বাধীনতা পেয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। একাত্তরে ঢাকার রেসকোর্স ময়দান থেকে মুক্তির সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের সেই ভাষণে তিনি হুংকার দিয়েছিলেন, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” কাঁটাতার পেরিয়ে সেই প্রতিরোধের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছিল এপার বাংলাতেও। আর তার প্রতিধ্বনিতেই এপার বাংলায় বেজেছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাঁধা গান-
”শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি…
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।”
আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে রাতে ‘সংবাদ পরিক্রমা’য় বাজানো হয়েছিল সেই গান। বঙ্গবন্ধুর ওই ঐতিহাসিক ভাষণ সম্প্রচারের মাঝে মাঝেই শোনা গিয়েছিল- ‘লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’। আর সেইদিন সকালেই এ গান বেঁধেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। যেভাবে সে গান লেখা হয়েছিল, তা-ই যেন এক গল্প।
আরও শুনুন:
ভাঙল মূর্তি, বঙ্গবন্ধুর হিন্দু-মুসলিমকে রক্ষার কর্তব্য মনে রাখবে তো ‘নতুন’ বাংলাদেশ?
কলকাতার রামগড় এলাকায় পদ্মশ্রী সিনেমা হলের কাছাকাছি এক চায়ের দোকান। সেখানেই নিয়মিত আড্ডা জমাতেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসঙ্গীতের অধ্যাপক দিনেন্দ্র চৌধুরী, আকাশবাণীর প্রযোজক উপেন তরফদার, অংশুমান রায় প্রমুখ আরও অনেকে। একাত্তরের এপ্রিল মাসে ১৩ কিংবা ১৫ তারিখ সেটা, সেদিনই আড্ডায় স্পুল টেপ রেকর্ডার এনে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ শুনিয়েছিলেন উপেন তরফদার। এই নিয়ে আলোচনার মাঝেই নিজের চারমিনার সিগারেটের প্যাকেটের সাদা কাগজে কী যেন লিখছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। একসময় বন্ধুদের হাতে সেই কাগজটা দিয়েই দেখতে বলেন তিনি। সেই সিগারেটের কাগজেই লেখা ছিল এ গান, যা হয়তো এপার বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম গান। তারপরেই শুধু হারমোনিয়াম দিয়ে গানে সুর দেন অংশুমান রায়। আর তালবাদ্য বলতে নাকি ছিল একটা শক্ত মলাটের গানের খাতায় দিনেন্দ্র চৌধুরীর তাল ঠোকা। ওই স্পুল রেকর্ডারেই গানটা রেকর্ড করে নিয়েছিলেন উপেন তরফদার। আকাশবাণীর সংবাদ পরিক্রমার জন্য যে নির্ধারিত সময়সীমা ছিল, ভাষণে তার চেয়ে সময় কম পড়ছিল। সেই ফাঁক পূরণ করতেই এই গান ভাষণের মাঝে মাঝে বাজিয়ে দেন আকাশবাণীর প্রযোজক উপেন তরফদার।
আরও শুনুন:
ভাষার লড়াই থেকে শাহবাগ, আন্দোলনের পথে এগিয়েছে যে বাংলাদেশ…
৭১-এর যুদ্ধের আগে পরে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল আকাশবাণীর ওই অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে বাজতেই রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যায় গানটি। মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই নানা জায়গায় বলেছেন বা লিখেছেন যে, আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে যখনই এই গানটা বাজানো হত, তখনই নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা পেতেন তাঁরা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে গৌরীপ্রসন্ন-অংশুমান সহ এপার বাংলার জনাকয়েক গায়ক-গীতিকারকে সম্মাননা জানাতে চেয়েছিলেন খোদ বঙ্গবন্ধুও। তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার জেরে সেই ভাবনা আর পূর্ণতা পায়নি। যদিও চায়ের আড্ডায় বসে তৈরি করা সেই গান কিন্তু রয়েই গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে।