বদলাতে হবে মিষ্টির নাম। মুছতে হবে ‘পাক’ শব্দ। রাতারাতি নতুন নামকরণ হল, মাইসোর পাক, আমপাক, মোতিপাকের মতো বিখ্যাত সব মিষ্টির। তবে দেশপ্রেমকে সামনে রেখে যেভাবে এই নামবদল অভিযান করা হচ্ছে, তাতে কী লাভ হবে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
নামে কি আদৌ কিছু আসে যায়? বর্তমান পরিস্থিতি বলছে অবশ্যই যায় আসে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাই বিষয়টা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। জানা যাচ্ছে, দক্ষিণের বিখ্যাত মিষ্টি মাইসোর পাক-এর নাম বদলের দাবি উঠেছে। কিছু দোকানে তা করাও হয়েছে। আপত্তি কারণ, ‘পাক’ শব্দটি। যে অর্থেই ব্যবহার হোক, পাক শব্দ উচ্চারণ করা চলবে না। অগত্যা নামবদল একমাত্র পথ।
নাম বদলে দেশের ইতিহাসের একাংশ মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একাধিক বার এই অভিযোগ উঠেছে। বিশেষত মুঘল ইতিহাসকে প্রায় বিস্মৃত করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে সরব হয়েছেন বহু ভাবুক-চিন্তকও। তা সত্ত্বেও মোদি সরকারের জমানায় একের পর এক ঐতিহাসিক স্থানের নাম বদলের সাক্ষী থেকেছেন দেশবাসী। রাষ্ট্রপতি ভবনের ঐতিহাসিক ‘মুঘল গার্ডেন্স’ বর্তমানে ‘অমৃত উদ্যান’ নামে পরিচিত। উদাহরণ আরও কতশত রয়েছে হিসাব রাখা কঠিন। তবে এসব যে কোনও আকস্মিক পদক্ষেপ নয়, তা এই সরকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপের ‘ক্রনোলজি’র দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়। প্রত্যাশিত ভাবেই এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা। যুক্তি ছিল, এর মধ্যে ঔপনিবেশিকতার ভার বয়ে যাওয়া থেকে মুক্তির দিশা রয়েছে। দেশের মধ্যে উত্তরপ্রদেশে নাম বদলের ঘটনা সবথেকে বেশি লক্ষ করা গিয়েছে। সৌজন্যে, সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। তবে এবারের বিষয়টা খানিক আলাদা। কোনও রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে নয়, সাধারন ব্যবসায়ীরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নাম বদলের। তাও আবার জনপ্রিয় কিছু মিষ্টির।
ভারত-পাক সংঘাতের আবহে সোশাল মিডিয়া নানা দাবি উঠতে শোনা গিয়েছে। কখনও পাক শিল্পীদের বয়কটের ডাক, কখনও অন্য কিছু। তবে নামে পাক রয়েছে এমন সবকিছুকে বয়কট করতে হলে বিপাকে পড়তে হয় বইকি। একথা সত্যি পাকিস্তানকে এই মুহূর্তে শত্রুদেশ বলেই চিহ্নিত করছেন অনেকে। তাতে আপত্তি তো নেই, বরং পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বাকিদের। সেই প্রসঙ্গ ধরে শত্রুদেশের নামের আদ্যভাগ রয়েছে এমন সবকিছুই ভারতে নিষিদ্ধ করতে চাইছেন কেউ কেউ। এখানেই সমস্যা। কারণ পাক শব্দটির আলাদা অর্থ রয়েছে। মূলত রান্না করা বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মিষ্টির নামে পাক শব্দের উপস্থিতিও সেই সূত্রেই। এছাড়া আরও নানাভাবে পাক শব্দটি নিত্যদিনের কথাবার্তায় ব্যবহার হতে পারে। পাকচক্রে সেসব বদলানো আদৌ সম্ভব কিনা প্রশ্ন থাকবেই। তবে মিষ্টির নাম চাইলেই বদলানো যায়। তাই রাতারাতি মাইসোর পাক, মোতিপাক, আমপাকের মতো জনপ্রিয় মিষ্টির নাম বদলানো হয়েছে বহু দোকানে। বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘শ্রী’ শব্দটি।
জানা গিয়েছে, মোতি পাক, আম পাক, গন্ড পাক ও মাইসোর পাকের মতো মিষ্টি এখন নাম বদলে হয়েছে মোতিশ্রী, আমশ্রী, গন্দশ্রী এভং মাইসোরশ্রী। এছাড়া বিখ্যাত বিকানেরি মোতি পাক এবার থেকে পরিচিত হবে বিকানেরি মোতিশ্রী নামে। চান্দি ভস্ম পাকের নতুন নাম চান্দি ভস্মশ্রী। একইভাবে স্বর্ণ ভস্ম পাক হয়েছে স্বর্ণভস্মশ্রী। অর্থাৎ সবরকম ‘পাক’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশপ্রেমের আবহে বিষয়টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ক্রেতারাও। একবারের জন্যও কেউ ভেবে দেখেননি মিষ্টির নামে থাকা ‘পাক’ আসলে পাকিস্তানের দ্যোতক নয়। রান্না করা অর্থাৎ ‘পাকওয়ান’ থেকেই মিষ্টিগুলির নামের সঙ্গে সংক্ষেপে পাক জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য ক্ষেত্রে নামবদলের সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির অভিযোগ উঠতেই পারে। এক্ষেত্রে সে বালাই নেই। তাই বিষয়টা সঠিক না ভুল সেসব আলোচনার প্রয়োজন মনে করেননি কেউ। অন্যান্য বিষয়ের মতো এই নিয়েও চর্চা চলছে। সোশাল মিডিয়ায় অনেকেই বিষয়টা বেশ প্রশংসা করেছেন। তবে এইসবের আড়ালে আসল আলোচনার বিষয়গুলো কি চাপা পড়ে যাচ্ছে না? ওয়াকিবহাল মহলে সেই প্রশ্নও উঠছে বইকি। কী করলে জঙ্গি হামলার মতো ঘটনা এড়ানো সম্ভব, কী করলে নিরাপত্তা আরও সুরক্ষিত হবে, সেসব নিয়ে আলোচনা করা বা পদক্ষেপ করাই হয়তো দেশপ্রেমের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তার জায়গায় সাম্প্রদায়িক বিষয়গুলোকে সামনে আনা, বা এই ধরনের নাম বদলের মতো পদক্ষেপ, অনেক প্রশ্নই আড়ালে রেখে দিচ্ছে।