বাড়ির অমতে বিয়ে করলে পুলিশি সুরক্ষা মিলবে না। সম্প্রতি এমনই মন্তব্য করেছেন এলাহাবাদ আদালতের বিচারপতি। ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। উঠতে শুরু করছে বিভিন্ন প্রশ্ন। তার মধ্যে সবচেয়ে জরুরি বোধহয় ‘অনার কিলিং’-এর প্রসঙ্গটাই। আদালতের রায় কি এই সংক্রান্ত বিপদ আরও বাড়িয়ে দেবে?
দীর্ঘদিনের প্রেম। এদিকে বাড়ির কারও বিয়েতে মত নেই। বাধ্য হয়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যুগলকে। নিজেদের মতো বিয়েও সেরেছেন তাঁরা। কিন্তু তাতেও শান্তি মেলেনি। পরিবারের সম্মান খোয়া গিয়েছে, এই দাবিতে যুগলের জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে তাঁদেরই পরিবার। ঘটনার আকার এমনই বীভৎস হয়ে উঠেছে, মৃত্যুভয়ও পিছু ছাড়ছে না ওই যুগলের।
সিনেমা, সিরিয়াল নয়, বাস্তবেও এমন ঘটনার উদাহরণ রয়েছে ভুরি-ভুরি। বলা ভালো সেইসব বাস্তব ঘটনার অনুকরণেই তৈরি হয়েছে সিনেমা। সেখানে যতই পরিবারের অমতে বিয়েটা হাসি-ঠাট্টার আড়ালে দেখানো হোক, বাস্তবে বিষয়টা বেশ গুরুতর। বিশেষ করে পরিবারের তরফে ওঠা আপত্তি যদি মারাত্মক রূপ নেয়। সংসবিধান যে স্বাধীনতার অধিকার দেয়, তাতে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নিজেদের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতেই পারেন। এতদিন এই ধরনের ঘটনায়, প্রয়োজন হলে পুলিশি নিরাপত্তাও পেতেন ওই যুগলরা। সেক্ষেত্রে থানায় গিয়ে নিরাপত্তার দাবি জানানোই যথেষ্ট ছিল বলা যায়। কিন্তু আগামীদিনে এমনটা হবে না। এলাহাবাদ আদালতের বিচারপতির মন্তব্য, যেসব দম্পতি পরিবারের অমতে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেন, তাঁদের জীবন এবং স্বাধীনতায় প্রকৃত হুমকি না থাকলে, পুলিশি সুরক্ষা দাবি করতে পারবেন না। বিচারপতির দাবি, এই ধরনের সুরক্ষার দাবি কারও অধিকার হতে পারে না। তাই সবাইকেই সুরক্ষার জন্য পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, আদালত একটি উপযুক্ত মামলায় আবেদনকারী দম্পতিকে নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে। পাশাপাশি মনে করিয়ে দেন, কোনও হুমকির আভাস না থাকলে, সেই দম্পতিকে একে অপরকে সমর্থন করতে এবং সমাজের মুখোমুখি হতে শিখতে হবে। অর্থাৎ বিষয়টাকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখেছেন বিচারপতি। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এহেন পর্যবেক্ষণ সমালোচনার কেন্দ্রে পৌঁছেছে। সেক্ষেত্রে সবথেকে জোরলো হচ্ছে যে দাবি, তা ‘অনার কিলিং’-এর।
‘ধড়ক’ বা ‘ভেদা’-র মতো সিনেমায় বিষয়টা বেশ স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তব যা ঘটে তা এত সিনেম্যাটিক নয়। বরং তাতে মিশে থাকে সামাজিকতা নামে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা অনায়াসে বদলে দিতে পারে অনেককিছুর সমীকরণ। অনেক সময় দেখা যায়, স্রেফ পরিবারের মান-মর্যাদা রক্ষার দোহাই দিয়ে সেই পরিবারেরই কাউকে হত্যা করা হল, অথচ তা সহজভাবে মেনে নিল পাড়া-প্রতিবেশী। আসলে, কেউ বাড়ির অমতে বিয়ে করলে পাড়াতেও কম চর্চা হয় না। কেউ কেউ এমন দাবি করেন, এই ঘটনা পাড়ার নাম খারাপ করল! বিষয়টা তাও মেনে নেওয়ার পর্যায় থাকে, যদি প্রেমিক বা প্রেমিকার ধর্ম এক হয়। ভিনধর্মের কারও সঙ্গে বিয়ে, বাড়ি কেন গোটা সমাজ সহজে মেনে নিতে পারে না। শাস্তি দিতেই হবে এমন একটা মনোভাব চলে আসে সেই পাড়ার ইন্দ্র-মিত্র-বরুনদেরও। কখনও মুখের কথায় বুঝিয়ে কাজ হয়, কখনও তাও নয়। সেক্ষেত্রে শাস্তি বলতে একটাই নিদান উঠে আসে, মৃত্যুদণ্ড। আইনের চোখ এড়িয়ে এমন ঘটনা আখচার ঘটছে। আদালতের রায় কি আরও মসৃন করল সেই পথ, প্রশ্ন উঠছে ওয়াকিবহাল মহলে। আদালতের যুক্তি অনুযায়ী, প্রকৃত হুমকি দেখালে পুলিশি সুরক্ষা মিলবে। কিন্তু একটু ভাবলেই দেখা যাবে, যারা পালিয়ে বিয়ে করার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাঁরা হয়তো ওই হুমকির ভয়েই এমন কাজ করেছেন। হয়তো প্রাথমিক পর্যায়ে মৃত্যভয় অবধি ব্যাপারটা এগোয়নি, কিংবা ভিনধর্মের কারও সঙ্গে সম্পর্কের কথা ফাঁস হলে গোড়াতেই সেই ভয় দেখানো হয়েছে, যা সহ্য করতে না পেরে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নিতে হয়েছে তাঁদের।
আসলে, ধর্ম দেখে তো ভালোবাসা হয় না। প্রেমের ক্ষেত্রে এমন বাদ-বিচার চলে না। তাই পরিবারের মানা, না মানার ভরসায় নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিতে নারাজ থাকেন অনেকেই। ভবিষ্যতে সমস্যা হবে, একথা জেনেবুঝেই পালানোর সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। এমন কেউ আলাদা করে কীভাবে টের পাবেন, কোনটা হুমকি এবং তা কখন, কীভাবে আসবে! সুতরাং আগেভাগে পুলিশি নিরাপত্তা না পেলে, সমস্যা আর ভয় নিয়েই যে দিন-গুজরান করতে হবে তাঁদের, একথা বলাই যায়। আর সেখানেই ওয়াকিবহাল মহলের আশঙ্কা, যে ভয় নিয়ে ওই যুগল দিন কাটাবেন, হুমকি আসার আগে তা সত্যি হয়ে যাবে না তো?