এ-দেশ শান্তি আর অহিংসার। পৃথিবীর কাছে এই হল ভারতের পরিচয়। যুগে যুগে সমন্বয়ের কথা বলেছেন এ দেশের মনীষীরা। কিন্তু প্রশ্ন হল, মানুষ কতটুকু গ্রহণ করেছে সেই উপদেশ? আধুনিক সময়েও হিংসা আর হানাহানির সংক্রমণ দেখে সংশয় জাগে। কিন্তু এ কথাও তো ভুলে যাওয়ার উপায় নেই, বিদ্বেষের পাশাপাশিই জেগে থাকে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। এক সাম্প্রতিক ঘটনায় তেমনই প্রমাণ মিলল আবারও।
ভারতের সংবিধান এ দেশকে চিহ্নিত করেছে ধর্মনিরপেক্ষ বলে। সত্যি বলতে, তেমনটাই তো হওয়ার কথা। এই তো সেই দেশ, যেখানে চৈতন্যদেব প্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে দেন যবন-মুচি-চণ্ডালকে; কবীর দোঁহা লিখে ছড়িয়ে দেন সম্প্রীতির বাণী। আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন ‘যত মত তত পথ’। এই দেশের ইতিহাস বরাবর সমন্বয়ের কথাই বলে। কিন্তু, সময় বদলায়। তার সঙ্গে সঙ্গে বদলায় সমাজও। তাই হঠাৎ হঠাৎ ফাঁক বুঝে ঢুকে পড়ে বিদ্বেষের হাওয়া। সেই বদ হাওয়া গায়ে লাগলে সমন্বয়ের পাখি যায় উড়ে। বহুদিন পাশাপাশি থাকা দুই মানুষও একে অপরের বিরুদ্ধে নেমে পড়ে লড়াইয়ের ময়দানে।
আরও শুনুন: প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে হুইলচেয়ার সম্বল করেই ৫৯টি দেশে ভ্রমণ, নজির এই মহিলার
এ ঘটনাও আর নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক কালে ফের মাথাচাড়া দিতে চাইছে তেমনই বিভেদকামী হাওয়া। তারই নিদর্শন কিছুদিন আগেই মিলেছে হরিদ্বারে। ধর্মসংসদ থেকে উঠে আসা বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে ফের সরব হয়েছেন দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ।
শুভবুদ্ধি বলে, যে কোনও বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ হওয়াই উচিত। কিন্তু কখনও সখনও পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে প্রতিবাদ করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অথচ, সেই সাহসী কাজটাই করে দেখিয়েছেন ২৫ বছরের যুবক গুলবাহার কুরেশি। ধর্মসংসদের ওই বিতর্কিত মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন তিনি আইনের পথেই। অভিযোগ দায়ের করেন থানায়। পুলিশ প্রথমে মাত্র একজনের নামে অভিযোগ নিয়েছিল। কিন্তু হার মানতে হয় কুরেশির অধ্যবসায়ের কাছে। বিতর্কিত মন্তব্যকারী সকলের বিরুদ্ধেই শেষমেশ অভিযোগ গ্রহণ করে পুলিশ।
হরিদ্বারের মাটিতে দাঁড়িয়েই এহেন পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে কুরেশির ভয় পাওয়ারই কথা। ভয় যে পেয়েছিলেন, তা অস্বীকার করছেন না আইন বিষয়ে পাঠরত কুরেশি। কিন্তু আত্মরক্ষার চেয়ে দেশের সংবিধানকে রক্ষা করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল তাঁর। আর সেই কারণেই আইনের সাহায্য নিয়েছেন তিনি, জানিয়েছেন গুলবাহার কুরেশি।
আরও শুনুন: শৈশবে বিনামূল্যে মিলেছিল বাদাম, বড় হয়ে বিক্রেতার ঋণ শোধ করলেন প্রবাসী ভাই-বোন
ঘটনার জল এবার গড়াবে আইনি পথেই। তবে এই সবকিছুর মধ্যেই স্বতন্ত্র একটা জায়গা নিয়েছেন কুরেশি। ভয় না পেয়ে দেশের সংবিধানের স্বার্থে যে বিদ্বেষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত, এবং তরুণ প্রজন্ম যে তাতে পিছপা নয়, সেই কথাটি প্রমাণ করে দিয়েছেন। কুরেশি মনে করেন, কোথাও কোনও প্রতিবাদ না হলে বিদ্বেষ ক্রমশ বেড়ে উঠবে। তাই প্রতিবাদের কাজটাই শুরু করেছিলেন তিনি। আর প্রতিবাদ যে ক্রমশ নিজের রাস্তা খুঁজে নেয়, সে কথাও লেখা আছে এ দেশের ইতিহাসেই।