চলতি বছর, অর্থনীতিতে যে নোবেল এল, সেখানেও এই মানুষের নিজস্ব সংখ্যাশক্তির উপর বিশেষ আলোকপাত হয়েছে। কেননা একাধিপত্যের বিরুদ্ধে সেটিই মানুষের লড়াইয়ের শক্তি। অনেকটা যেন সেই দর্শনেই নিজের আন্দোলনকে টেনে এনেছেন সোনম ওয়াংচুক। নিশ্চিতই তিনি একটি শাসনশক্তির পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই তার স্বর তুলে ধরছেন। তবে সেখানেই সীমাবদ্ধ করছেন না।
সোনম ওয়াংচুক। লাদাখের জন্য, পরিবেশ রক্ষার জন্য তাঁর আন্দোলনের সঙ্গে দেশবাসী পরিচিত। সম্প্রতি সেই আন্দোলনের সীমাকে তিনি আরও প্রসারিত করতে চেয়েছেন। তুলে এনেছেন দেশের রাজধানীতে। একই সঙ্গে এই আন্দোলনের মাত্রাও বদলে দিয়েছেন তিনি। তা রাজনৈতিকভাবে শুধু নয়, বরং অনেকটাই দর্শনগত জায়গা থেকে। ওয়াংচুক সারা দেশের মানুষকে এক দিনের অনশন পালনের যে ডাক দিয়েছিলেন, তা শুধু লাদাখের জন্য নয়। ওয়াংচুক বলেছেন, এই অনশন হোক সামগ্রিকভাবে ভোগবাদের বিরুদ্ধেই। ফলত এই আন্দোলন শুধু কোনও ক্ষমতাশীল শক্তির বিরুদ্ধে থাকছে না। হয়ে উঠছে আত্মশক্তি জাগরণের ক্ষেত্র। সময়ের নিরিখেই তাই ওয়াংচুকের এই ডাক অন্য গুরুত্ব বহন করছে।
একেবারে প্রাথমিকভাবে দেখতে গেলে, ওয়াংচুকের এই আন্দোলন লাদাখের জন্যই। তবে, এই সূত্রেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন ওয়াংচুক। তাঁর বক্তব্য, লাদাখ কি শুধু লাদাখবাসীর? তা তো গোটা দেশেরই। তাই লাদাখের জন্য যে আন্দোলন, তা আদতে দেশবাসীরই আন্দোলন। গোটা দেশের মানুষেরই সামগ্রিকভাবে সে আন্দোলনে অংশ নেওয়া জরুরি। কেন? ওয়াংচুক বলছেন, আমাদের আগামী প্রজন্ম কী খাবে, কতখানি বিশুদ্ধ জল পান করবে, কোন বাতাসে শ্বাস নেবে- তার জন্যই এই আন্দোলন। পরিবেশ রক্ষার যে কোনও আন্দোলনকেই সাধারণত আঞ্চলিকতায় বেঁধে ফেলা হয়। যেন, ভূমিধস বা বন্যা কিংবা খরা কোনও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সমস্যা। তার প্রতিকার তাই আঞ্চলিকভাবেই করা সম্ভব। সেই হেতু অঞ্চলের মানুষের ক্ষোভ-রাগ-অভিমান অন্যদের বিচলিত করলেও, প্রভাবিত করে না সেভাবে। সোনম ওয়াংচুক আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন সেই পুরনো কথা যে, নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায় না। মানুষের হাতে পরিবেশের যে হারে ধ্বংসাধন হয়েছে, তাতে কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এমনটা নয়। সেই প্রভাব পড়বে গোটা মানবসভ্যতার উপরেই। ফলে পরিবেশ রক্ষার্থে যে আন্দোলন তা আমাদের সামূহিক স্বার্থের কারণেই। তা কারও ব্যক্তিগত আন্দোলন হতে পারে না। আন্দোলনের সীমাকে এই যুক্তিতে অনেকটাই প্রসারিত করে দিয়েছেন তিনি।
দ্বিতীয়ত, তাঁর বক্তব্য, যে অনশন কর্মসূচির ডাক তিনি দিয়েছেন, তা হয়ে উঠুক ভোগবাদের বিরুদ্ধে। আরও গূঢ় সমস্যা এবং আমাদের যাপনের মৌলিক অভ্যাসকেই এখানে ধাক্কা দিতে চেয়েছেন সোনম। মুক্ত অর্থনীতি আমাদের, যে জীবনে অভ্যস্ত করে তুলেছে তা যেন শাঁখের করাত। সেই চক্রব্যুহে আমরা ঢুকে পড়তে পারি খুব সহজে। কিন্তু বেরনোর উপায় যেন জানা নেই। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে আছে পুঁজির আগ্রাসন। জল, জঙ্গল, প্রকৃতি সবকিছুরই দখল নিতে চায় তা। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বাড়বাড়ন্ত হলে মানুষের হাতে যেন আর কিছুই থাকে না। ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রকৃতির রোষ তাকে বিপন্ন করে। সেই বিপন্নতা নতুন করে কষ্ট এবং দৈন্য ডেকে আনে। অন্যদিকে প্রলোভনের জীবন তাকে আবার একই ফাঁদে পা দিতে বাধ্য করে। অর্থাৎ মানুষ দিনে দিনে তার কৃতকর্মের ভার বওয়া সিসিফাস হয়ে দাঁড়ায়।
এর থেকে বেরনোর কি কোনও উপায় নেই? যদি কিছু থাকে, তাহলে এই আত্মশক্তিই। সোনম বলছেন, পরিবেশকে যদি রক্ষা করতেই হয়, তাহলে ভোগবাদের সহজ সূত্রগুলিকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে আমাদেরও। আমাদেরও খেয়াল রাখতে হবে, যাতে অতি মাত্রায় বিদ্যুতের ব্যবহার না করি। জলের অপচয় না করি। গ্রিন হাউস গ্যাস, যা কিনা মানবসভ্যতার অস্তিত্বকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে তা কমানোর দিকে আমাদেরও খেয়াল দিতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন যানবাহন এবং যন্ত্র ব্যবহারে প্রয়োজনো মতো লাগাম টানতে হবে। যাতে আমাদের হাত দিয়েই পরিবেশের ধ্বংস আরও ত্বরান্বিত না হয়। এই বিন্দুতে এসেই সোনম ওয়াংচুকের অনশনের ডাক, অনশন শব্দটিরই অর্থ এবং মাত্রা বদলে দিচ্ছে। তা আর কেবল খাবার না খেয়ে থাকা নয়। বরং সেই ন্যূনতম জীবন যাপনের কথা বলছে, যাতে পরিবেশও মানুষের সম্পর্ক বিষময় না হয়ে ওঠে।
এই যাপনের পথে হাঁটা সম্ভব একমাত্র আত্মশক্তি জাগরণের মধ্য দিয়েই। পরাক্রমী ক্ষমতা যখন চারিদিক থেকে কণ্ঠরোধ করতে চায়, তখনও মানুষের হাতে থেকে যায় এই শক্তি। তার এক লড়াই বাইরের সঙ্গে, অন্য লড়াই ভিতরে ভিতরে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যখন লড়াইয়ের কথা বলছিলেন রবীন্দ্রনাথ বা তার প্রতি সংস্কৃতি নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন, তখন তিনি এই ভিতরের জাগরণকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন। একই মত ছিল গান্ধীরও। এই আত্মশক্তি যদি জনগণের সমষ্টির শক্তিতে রূপান্তরিত হয় তবে সদর্থক বদল আনা সম্ভব। চলতি বছর, অর্থনীতিতে যে নোবেল এল, সেখানেও এই মানুষের নিজস্ব সংখ্যাশক্তির উপর বিশেষ আলোকপাত হয়েছে। কেননা একাধিপত্যের বিরুদ্ধে সেটিই মানুষের লড়াইয়ের শক্তি। অনেকটা যেন সেই দর্শনেই নিজের আন্দোলনকে টেনে এনেছেন সোনম ওয়াংচুক। নিশ্চিতই তিনি একটি শাসনশক্তির পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই তাঁর স্বর তুলে ধরছেন। তবে সেখানেই সীমাবদ্ধ করছেন না। বরং জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে আমাদের নিজস্ব শক্তিতে আসীন হওয়ার অস্ত্রটিকে আবার যেন নতুন করে চিনিয়ে দিচ্ছেন, ভোগবাদের বিরুদ্ধে তাঁর এই অনশনের ডাকে।