ঘৃণাভাষণে জর্জরিত দেশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যার সূত্রপাত নেতা-মন্ত্রীদের থেকেই। বাক স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত, তবে তার প্রশ্রয়ে কি যা ইচ্ছে তাই বলা যায়? বাক স্বাধীনতায় কি লাগাম টানার সময় এসে গিয়েছে? এরকমই একাধিক প্রশ্ন খতিয়ে দেখছিল সুপ্রিম কোর্ট। আর সেই সূত্রেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণের কথা জানালেন বিচারপতি বি ভি নগারত্ন। কী বললেন তিনি? আসুন শুনে নিই।
নোট বাতিলের বৈধতা সংক্রান্ত প্রশ্নে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। সাংবিধানিক বেঞ্চের চারজন যখন একদিকে, তখন তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত বেআইনি। কেননা নোট বাতিল তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। বিচারপতি বি ভি নাগরত্নের বলিষ্ঠ মত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল গোটা দেশের। বাক স্বাধীনতার প্রশ্নে অবশ্য পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের সঙ্গে সহমতই পোষণ করলেন তিনি। জানিয়ে দিলেন, সংবিধানের ১৯(২) ধারায় উল্লিখিত বিধিনিষেধ ছাড়া, এই মুহূর্তে বাক স্বাধীনতায় নতুন করে রাশ টানার দরকার নেই। তবে নেতা-মন্ত্রীদের যথেচ্ছ ভাষণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মতও জানিয়ে রাখলেন তিনি।
আরও শুনুন: একমুখ দাড়ি-গোঁফ নিয়েই প্রকাশ্যে, রাহুল গান্ধীর নতুন রূপের নেপথ্যেও কি রাজনৈতিক বার্তা?
নির্বাচনের সময় বা কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে নেতা-মন্ত্রীরা যে ভাষায় আক্রমণ করেন, তা শালীনতার সীমা পেরোয় বলেই অভিযোগ ওঠে। পাশাপাশি এই ধরনের কথাবার্তা অন্য একটি প্রশ্নও তুলে দেয়। তা হল, বাক স্বাধীনতার আড়াল নিয়ে ঠিক কী বলা যায়? কতদূর বলা যায়? আমাদের সংবিধান জানায়, বাক স্বাধীনতা আছে বটে, তবে অন্যের সম্মানহানি হয় এমন স্বাধীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। বলা বাহুল্য, কার্যক্ষেত্রে এই সাংবিধানিক মূল্যবোধের কথা অধিকাংশ সময় বিস্মৃত হন নেতা-মন্ত্রীরা। ফলত নানা অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি খতিয়ে দেখছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই সূত্রেই পাঁচ সদস্যের এক সাংবিধানিক বেঞ্চ মঙ্গলবার জানিয়েছে যে, এই মুহূর্তে বাক-স্বাধীনতায় নতুন করে কোনও নিষেধাজ্ঞা আরোপের দরকার নেই। সংবিধান যে নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছে, তা মান্য করলেই চলবে। আর যদি কোনও নেতার কথা সংবিধানকে লঙ্ঘন করে, তবে স্বাভাবিক আইনি নিয়মেই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো যেতে পারে। এরপর আইন তার নিজের পথে চলবে।
আরও শুনুন: খাতায়-কলমে আছে, তবু কেন্দ্রের নজর এড়িয়ে দেশ থেকে গায়েব ৫০ মনুমেন্ট, কেন জানেন?
তবে মূল রায়ের সঙ্গে সহমত হলেও, এদিনও কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বিচারপতি নাগরত্ন। যেমন, নেতা-মন্ত্রীদের বক্তব্যের জন্য সরকার দায়ী থাকবে কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরে নাগরত্ন জানিয়েছেন, যদি কোনও মন্ত্রী তাঁর সরকারি পদমর্যাদাবলে অর্থাৎ ‘অফিসিয়াল ক্যাপাসিটি’-তে কোনও মন্তব্য করেন, তবে তাতে সরকারকেও খানিক দায়ভাগ নিতে হবে। অন্যথায় তা মন্ত্রীর ব্যক্তিগত মন্তব্য বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ একজন মন্ত্রীর সবরকম কথাবার্তাকে এক ছাঁচে ফেলতে নারাজ নাগারত্না। তাঁর মতে, আদালত নেতা-মন্ত্রীদের জন্য নির্দেশিকা তৈরি করে দিতে চায় না, কেননা এটা দেখভাল করা সংসদের কাজ। তাহলে নেতা-মন্ত্রীদের যথেচ্ছ ভাষণে কি কোনওরকম নিয়ন্ত্রণ থাকবে না? এই প্রশ্নে এসে নগারত্নর পর্যবেক্ষণ, এই নিয়ন্ত্রণ দলগুলিকেই করতে হবে। নির্দিষ্ট দলের মন্ত্রীরা কী বলবেন আর বলবেন না, সেই আচরণবিধি বা ‘কোড অফ কনডাক্ট’ তৈরি করা দলেরই কাজ।
বাক স্বাধীনতায় নয়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ থেকে বিরত থাকলেন বটে। তবে ঘৃণাভাষণ, উসকানিমূলক বক্তব্য নিয়ে যে তিনি চিন্তিত এদিন তাঁর ব্যতিক্রমী পর্যবেক্ষণে তা স্পষ্টই করে দিয়েছেন বিচারপতি নগারত্ন।