এক দেশ এক ভাষার নীতি ভারতে প্রয়োগ করাই সম্ভব নয়। নেহরু বা ইন্দিরা কি বোকা ছিলেন যে তাঁরা এক ভাষার বদলে তিন ভাষা লাগু করতে চেয়েছিলেন? ভাষা-ধর্মের বিতর্কে পালটা প্রশ্ন ছুড়লেন জেএনইউ-র উপাচার্য। কী বলেছেন তিনি? শুনে নেওয়া যাক।
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান- এমন বৈচিত্র্যকেই ধারণ করে ছিল ভারতবর্ষ। আর সেই বৈচিত্র্যকে বজায় রেখেই ঐক্যের কথা বলেছে দেশের সংবিধান। সে ঐক্য সব বৈচিত্র্যকে এক ঢেঁকিতে পিষে পিণ্ড পাকিয়ে তোলা নয়, বরং বহুমাত্রিকতার অধিকারকে স্বীকার করেই এক দেশ হয়ে ওঠা। লোকসভার আবহে সে কথাই মনে করিয়ে দিলেন জেএনইউ-র উপাচার্য। বর্তমানে গোটা দেশকে এক সুতোয় বাঁধার নামে যে এক ভাষা এক ধর্মের আধিপত্য ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে, আর তার উপর শাসকের সিলমোহরও পড়ছে একরকম করে, সেই প্রবণতার বিরুদ্ধেই সরব হলেন তিনি। একইসঙ্গে মনে করিয়ে দিলেন যে, এর আগে নেহেরু কিংবা ইন্দিরা তাঁদের শাসনকালে এমন নির্দেশ জারি করার কথা ভাবেননি। আর তা যে করেননি, তার কারণ তাঁদের নির্বুদ্ধিতা নয়। বরং এ দেশের সংস্কৃতিকে চিনেছিলেন বলেই সে সংস্কৃতির উপর যা ইচ্ছে নিয়ম চাপিয়ে তাঁরা তাকে অস্থির করে তুলতে চাননি। আর তেমনটাই এ দেশের প্রেক্ষিতে বুদ্ধিমানের মতো কাজ বলে মনে করেন জেএনইউ উপাচার্য শান্তিশ্রী ডি পণ্ডিত।
আরও শুনুন :
দেশের সংবিধান বদলে গেলে কার কী লাভ? ব্যাখ্যা দিলেন অমর্ত্য সেন
বিগত সময় ধরে দেশে যত অশান্তি উসকে ওঠে, তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে তার মূলে রয়েছে অসহিষ্ণুতা। কখনও ভাষা নিয়ে, কখনও ধর্ম নিয়ে, কখনও খাদ্যাভ্যাস বা পোশাক নিয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানায়। সোজা কথায়, একে অন্যের মতকে গ্রহণ করতে না পারার দরুনই এহেন সমস্যা তৈরি হয়। অথচ এ দেশের সংবিধান গণতন্ত্রের কথা বলে। আর অন্যের মত, বিরোধী হলেও, তাকে সম্মান করাই গণতন্ত্রের মূল কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি দেখলে সংশয় জাগে যে সেই শর্ত কতখানি গুরুত্ব পাচ্ছে। আর এই প্রেক্ষিতেই সেই ভিন্নতার কথা মনে করিয়ে দিলেন উপাচার্য।
তিনি জানিয়েছেন, নেহরু বা ইন্দিরা যে ত্রিভাষা নীতি চালু করেছিলেন, তার বক্তব্য ছিল, পড়ুয়ারা তিনটি ভাষা শিখবে। যদি হিন্দিভাষী রাজ্য হয়, তবে ইংরেজি, হিন্দি এবং আরেকটি আধুনিক ভারতীয় ভাষা। আর যদি হিন্দিভাষী রাজ্য না হয়, তবে ইংরেজির পাশাপাশি সেখানকার স্থানীয় ভাষা ও তার সঙ্গে হিন্দিও পড়ানো হোক, এই ছিল সে আমলের শিক্ষানীতি। কিন্তু কেবলমাত্র হিন্দিকে সরকারি ভাষা বলে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, এমন কোনও নির্দেশ লাগু হয়নি কখনোই। বস্তুত ২২টি ভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেয় ভারত, হিন্দি তার মধ্যে একটি, কিন্তু একমাত্র নয়। একইভাবে কোনও একটি ভাষাকে সবার উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করছেন উপাচার্যও। ঠিক যেভাবে কোনও একটি ধর্মকে গোটা দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়া চলে না, তেমনভাবেই একটি ভাষাকেই সারা দেশ গ্রহণ করবে এমনটা মনে করাও সঙ্গত নয়।
আরও শুনুন :
লোকসভা নির্বাচনে ফিরে এলেন কার্ল মার্কস, ফেরালেন সেই মোদিই
শুধু ভাষা বা ধর্মই নয়, এই প্রসঙ্গে হিজাব বিতর্ককেও টেনেছেন তিনি। তাঁর মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউ হিজাব পরবেন কি না, তা তাঁর ব্যক্তিগত মত, ব্যক্তিগত রুচি। সে বিষয়েও কোনও ড্রেস কোড বা পোশাকবিধি চাপানোর বিরোধিতাই করছেন তিনি। তবে কেউ হিজাব পরতে না চাইলে তাঁকেও যে জোর করা চলে না, সে কথাও মনে করাচ্ছেন তিনি। এ সবকিছুকেই একমাত্রিক নিয়ম বলেই দেখছেন উপাচার্য, যা আদতে দেশের বহুমাত্রিকতাকে নাকচ করছে বলেই তাঁর মত। নেহরু-ইন্দিরার কথা টেনে সেই বহুমাত্রিকতার পক্ষেই সওয়াল করলেন জেএনইউ-র উপাচার্য।