দেশের দায়িত্বশীল প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বরা বারবার দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তাঁর সাম্প্রতিক ভাষণে সাফ জানিয়েছেন, সন্ত্রাসের মদতদাতা সরকার ও সন্ত্রাসের হোতাদের আলাদা করে দেখা হবে না। এটিই দেশের ঘোষিত নীতি। এখানে কোথাও ধর্মপরিচয় নেই। তা সত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, সন্ত্রাসীদের ধর্মীয় পরিচয় ধরেই দেশের সংখ্যালঘুদের মিলিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা, খানিক গোপনে খানিক প্রকাশ্যে থেকেই যায়।
পহেলগাঁও হামলা থেকে ‘অপারেশন সিঁদুর’। কাশ্মীরে সন্ত্রাস হামলা থেকে পাকিস্তানকে ভারতের যোগ্য জবাব। গত এক মাসে এ সব দেখতে দেখতেই, দেশ সাক্ষী থেকেছিল ধর্মীয় বিভাজনেরও। হামলার পরেই জেগে উঠেছিল তীব্র সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ। তবে, সে বিভাজনের বিষ সরিয়ে রেখে এক পরিচয়ে ফের একজোট হয়েছিলেন দেশের নাগরিকরা। ভারতবাসী- এই একটি পরিচয়েই গর্বিত হয়েছিলেন সকলে। তবে, শেষ পর্যন্ত এ-দেশে ধর্মীয় পরিচয় যে মুখ্য হয়েই থেকে যায় তা যেন ফের প্রমাণ করে দিল মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী বিজয় শাহের মন্তব্য। আর দুর্ভাগ্যক্রমে সে ধারণার কেন্দ্রে থেকে গেলেন দেশের বীরাঙ্গনা কর্নেল সোফিয়া কুরেশি।
সোফিয়া কুরেশি। অপারেশন সিঁদুর-এর পর দেশের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দৃঢ় ভাবে সন্ত্রাসের নিন্দা করেছেন। ভারতের প্রত্যাঘাতের খুঁটিনাটি জানিয়েছেন দেশের মানুষকে, গোটা বিশ্বকেও। ধর্মভিত্তিক হত্যা যে ধর্মভিত্তিক বিভাজন উসকে দেবে, এই ছিল সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য। পরে বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রীও সন্ত্রাসীদের এ উদ্দেশ্যের কথা জানিয়েছিলেন। তবে তাঁর সঙ্গে কর্নেল কুরেশি, ব্যোমিকা সিং একসঙ্গে এসে যেন বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়েছিল, ভারতের ঐক্য এত ঠুনকো নয় যে, সহজে তা ভাঙা যাবে। বরং ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যে সমালোচনা চলছিল, তাই-ই যে দেশের ভিত্তি, সে-কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন কর্নেল কুরেশিই। সেই কুরেশিকে প্রশংসা করতে গিয়েই বেফাঁস কথা বলে ফেললেন বিজয় শাহ্। বললেন, পাকিস্তানি জঙ্গিরা যেহেতু ভারতীয় বোনদের বিধবা করেছে, তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘ওদের’ সম্প্রদায়ের ‘বোনকেই’ বেছে নিয়েছেন পালটা আক্রমণের জন্য। প্রবীণ নেতা এহেন মন্তব্য ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর প্রশংসায় করে থাকলেও, কর্নেল সোফিয়া কুরেশির মতো সেনা অফিসারকে তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে চিহ্নিত করার প্রয়াস বিতর্ক ডেকে এনেছে। সত্যি বলতে, মন্ত্রীর এই মন্তব্য যেন দেশের ভিতরকার এক প্রবণতাকেই একেবারে হাটের মাঝে এনে ফেলেছে।
এ-কথা ঠিক যে, দেশের দায়িত্বশীল প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বরা বারবার দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তাঁর সাম্প্রতিক ভাষণে এ কথা জোর দিয়ে জানিয়েছেন। সাফ জানিয়েছেন, সন্ত্রাসের মদতদাতা সরকার ও সন্ত্রাসের হোতাদের আলাদা করে দেখা হবে না। এটিই দেশের ঘোষিত নীতি। এখানে কোথাও ধর্মপরিচয় নেই। থাকার কথাও ছিল না। বরং ছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে জোটবদ্ধ ভারতের জোরাল স্বরেরই প্রকাশ। তা সত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, সন্ত্রাসীদের ধর্মীয় পরিচয় ধরেই দেশের সংখ্যালঘুদের মিলিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা, খানিকটা গোপনে খানিকটা প্রকাশ্যে ছিলই। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই হেনস্তার শিকার হতে হয়েছিল বহু মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে। কোথাও মুসলিম অন্তঃসত্ত্বা নারীর চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেন চিকিৎসক; কোথাও বা কাশ্মীরী ছাত্রদের কোণঠাসা করে দেয় অন্যান্য ছাত্রেরা; কোথাও আবার নিম্নবিত্ত কাশ্মীরী শালওয়ালাকে রীতিমতো গণপ্রহারের বলি হতে হয়। বিচ্ছিন্ন হলেও এই ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে, সন্ত্রাস ও মুসলমানদের এক করে দেখার দৃষ্টি দেশের একাংশে থেকেই গিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অনুশীলন, রাষ্ট্রনেতাদের বিবৃতির পরও তা যে একেবারে মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে, এমনটা দাবি করা যায় না।
তবু অপারেশন সিঁদুর-এর প্রত্যাঘাত যেন দেশের ভিতরকার সেই মানসিকতাকে অনেকটাই রুখেই দিতে পেরেছিল। আর সেই বার্তা যেন স্বয়ং হয়ে উঠেছিলেন কর্নেল কুরেশি। তাঁর উপস্থিতি দেশের মানুষকে জানান দিচ্ছিল যে, যে সমীকরণ টানা হচ্ছে তা শুধু ভুল নয়, অযৌক্তিক এবং ভারতের মতো দেশে তা কোনওভাবেই কাম্য নয়। বরং সেই মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে ভারতবাসী হয়ে ওঠাই দেশের নাগরিকদের একমাত্র প্রার্থনা হওয়া উচিত। অপারেশন সিঁদুর-এর পর তিনি দেশের ঘরে ঘরে পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেও, এর আগে রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষা বাহিনীর হয়ে বহু কাজে অংশ নিয়েছেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। তাঁর কৃতিত্বের তালিকা রীতিমতো দীর্ঘ। তা সত্ত্বেও, বীর সেনা পরিচয় ছেড়ে, হয়তো দেশের এক বড় অংশের মানুষ কর্নেল কুরেশিকে স্রেফ ‘মুসলিম’ হিসাবেই গণ্য করে থাকেন, বিজয় শাহের মন্তব্যটি তারই প্রতিফলন।
এ দুর্ভাগ্য শুধু কুরেশির নয়, গোটা দেশেরই। যে মানসিকতার বিরুদ্ধ ইস্তাহার হয়ে উঠলেন তিনি, সেই মানসিকতার হাতেই কবজা হলেন তিনিও। এই আয়রনি কাম্য না হলেও ভারতের জন্য সত্যি, ঘোরতর বাস্তব। বাইরের শত্রুকে নিয়ে ভাবনার পাশাপাশি তাই এই মানসিকতাও বোধহয় কম চিন্তার বিষয় নয়। দেশের মন বদলাতে কি তবে ব্যর্থ হলেন বীরাঙ্গনা? উত্তরের দায় দেশের নাগরিকদেরই।