মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেওয়া কিংবা বেশি সন্তানের জন্ম দেওয়া! ভোট যত এগোচ্ছে তত রাজনৈতিক বয়ান আশ্রয় নিচ্ছে ধর্মের। আর সেই সবের বিপরীতে নীরবতাকেই কৌশল করেছেন দেশের মুসলিম অধিবাসীরা। কেন এমনটা মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
ইলেক্টোরাল বন্ড, স্থানীয় দুর্নীতি উধাও। এমনকি উন্নয়নের গল্পও যেন পিছিয়ে পড়েছে দৌড়ে। ভোটযুদ্ধে আবার মঞ্চ মাতাচ্ছে ধর্ম। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যে ভিন্নতা, তাকেই বিভাজনের ঘোড়া করে ভোটের অশ্বমেধে নামিয়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা। আর এই পরিস্থিতিতে সবথেকে সাবধানী বোধহয় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষত মুসলিমরা। হাজারও উসকানির বিরুদ্ধে নীরবতাকেই তাঁরা হাতিয়ার করেছেন বলে মনে করছেন রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা।
আরও শুনুন:
মঙ্গল-অমঙ্গলসূত্র! দুর্নীতিকে দূরে ঠেলে ভোট যেন সেই ‘ধর্ম’যুদ্ধ
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে এক দফা ভোট মিটেছে। আর সেই ভোটের পরিস্থিতির দিকে তাকিয়েই এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করছেন যে, ভোট যেভাবে বিভাজনের রাজনীতিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে খুব একটা জড়াতে চাইছেন না মুসলিম ভোটাররা। সম্প্রতি মুসলমানদের বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার অভিযোগ আবার ফিরে এসেছে রাজনীতির ময়দানে। বহুবার বহু বিশেষজ্ঞই তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্ম নয়, শিক্ষা এবং সচেতনতার বড় ভূমিকা আছে। অবশ্য ভোটের রাজনীতি সে যুক্তির তেমন ধার ধারেনি! ফলত এই তর্ক আবার নতুন করে ছড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেওয়ার রাজনৈতিক বয়ানেও যথেষ্ট উত্তপ্ত ভোটের হাওয়া। এই পরিস্থিতি নতুন নয়। রাম মন্দির বা জ্ঞানবাপীর মতো ইস্যুগুলি ভোটের আগেই ছিল। আর তা থেকে ভোটের রাজনীতির গতিপথটি সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছিলেন মুসলিম ভারতবাসীর একাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, তাই নীরবতা অবলম্বন করে ভোটকেই হাতিয়ার করে তুলতে চাইছেন তাঁরা।
সংখ্যালঘু ভোট বলতে এককালে যা বোঝানো হত, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই ধারণায় বড় বদল এসেছে। কিছুদিন আগের এক সমীক্ষা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছিল যে, দেশের মুসলিম-মানসে পরিবর্তন এসেছে। তা একরৈখিক কোনও বিষয় নয়। আগেও হয়তো ছিল না। তবু বদলে যাওয়া বাস্তবতায় তা আরও বেশি করে চোখে পড়ছে। আর সেই প্রেক্ষিতেই মুসলিম অধিবাসীদের এই নীরবতার কৌশল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গত এক দশকের বিভিন্ন ঘটনার দিকে তাকিয়ে মুসলিমরা বুঝেছেন যে, বিভাজনের রাজনীতি এক ধরনের স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। আর তাতে জড়িয়ে পড়ে সম্প্রদায় হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাঁরাই। কখনও আবার এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যা তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করছে। অতএব সেই রাজনীতি না আটকাতে পারলেও, উসকানিতে পা দেওয়া থেকে তাঁরা বিরত থাকছেন। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে, এর পিছনে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে ভয়। তবে, কারণ যাই-ই হোক না কেন, তাঁদের চিন্তাভাবনায় বদল যে এসেছে তা অনস্বীকার্য।
আরও শুনুন:
মুসলিম মহিলারা কি স্বামীর কথায় ভোট দেবেন? বিশ্বাস করেন না বিজেপি প্রার্থী মাধবী লতা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলিই নতুন একটা রাজনৈতিক ভাষার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে মুসলিম ভারতবাসীকে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আর নিজেদেরকে শুধু সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের তকমায় আটকে রাখতে নারাজ। অতীতে কী হয়েছে, তা নিয়ে টানাটানিতে তাঁরা নারাজ। সাম্প্রতিকের ভরকেন্দ্র ধরেই এগোতে চাইছেন তাঁরা। সেক্ষেত্রে শুধু একরকমের রাজনৈতিক বয়ানেও তাঁরা বিশ্বাসী নন সম্ভবত। বিভাজনের রাজনীতিকে সব দিক থেকেই হয়তো প্রত্যাখ্যান করতে চাইছেন তাঁরা। আর তাই ভোটের মুখে নীরবতাকেই ঠিকঠাক হাতিয়ার ভেবেছেন তাঁরা। দেশের গণতন্ত্রে ভোটদানের গুরুত্ব এখনও অসীম। আর তাই পালটে যাওয়া রাজনৈতিক বাস্তবতায়, বিবাদ নয়, নীরবে ভোট দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানই পরিষ্কার করতে চাইছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞদের মত, তাঁদের এই নীরবতা নিঃসন্দেহে ভারতীয় রাজনীতিতে শুধু নয়, সমাজের বিন্যাসেও নতুন একটি সংস্কৃতিরই জন্ম দিচ্ছে।