চারদিকে যখন সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা আর বিদ্বেষের ছবি! একের ধর্মীয় বিশ্বাসে প্রশ্ন তুলছে অন্য জন, তাঁর ভাবাবেগে আঘাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে অন্য কেউ! এই অশান্তির আবহে আশ্বাসের ছবি কি কোথাও নেই? কে বলেছে নেই? এই তিন বন্ধুকেই দেখুন তবে। যে যার ধর্ম পরিচয়, বিশ্বাস সব দূরে সরিয়ে রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছেন মইনুদ্দিন, শ্রীনাথ আর ভগৎ। তিন বন্ধু মিলে খুলে ফেলেছেন রান্নাবান্নার একটি ইউটিউব চ্যানেল। সেখান থেকে হওয়া রোজগার দিয়ে মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন অসংখ্য নিরন্ন শিশু, বৃদ্ধবৃদ্ধার মুখে। অন্নের থেকে বড় ঈশ্বর নেই, আর নিরন্নর মুখে খাবার তুলে দেওয়ার থেকে বড় কোনও ধর্ম নেই। এই বিশ্বাসে ভর করেই দিনরাত খেটে চলেছেন তিন বন্ধু। শুনে নিন, তাঁদের গল্প।
তাঁর প্রতিটা ভিডিও শুরু হয় আল্লাতালার নাম নিয়ে। খোলা প্রকৃতির মাঝখানে বসে স্টোভে আগুন উসকে দেন খাজা মইনুদ্দিন। পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, মাথায় ফেজটুপি। কড়াই তেতে উঠলে তাতে একে একে তেল-মশলা ছাড়েন। রান্নার সুঘ্রাণ ওঠে। মা-ঠাকুমার কাছ থেকে শেখা একের পর এক রেসিপি বলে যান মইনুদ্দিন। আর সেই সমস্ত কিছু ধরা থাকে ক্যামেরায়। নবাবের রসুই থেকে রান্নার রেসিপি টুকে নিতে পর্দায় সামনে বসে থাকেন অগণিত মানুষ। তাঁরা মইনুদ্দিনের রান্না দেখতে ভালবাসেন। ইউটিউবে অপেক্ষা করেন তাঁর ভিডিওর জন্য। কমেন্ট আর লাইকের বন্যায় ভাসে মইনুদ্দিনের ইউটিউব চ্যানেল নবাব’স কিচেন।
না, এ পর্যন্ত গল্প কিছু নতুন নয়। ইউটিউব চ্যানেল তো আজকাল অনেকেই খোলেন। দিনে দিনে জনপ্রিয়তা পায় সেসব। বাড়ে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা। সেখান থেকে আয়ও হয় কমবেশি। আজকাল অনেকের ক্ষেত্রেই এটা আর শুধু নেশা নয়, পেশাও বটে। এমন বহু ইউটিউবার রয়েছেন, যাঁরা ভিডিও বানিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা আয় করেন মাসে। তবে তাঁদের সঙ্গে মইনুদ্দিনদের তফাৎ একটাই। ইউটিউব থেকে হওয়া রোজগারের পুরোটাই তাঁরা দান করে দেন দুঃস্থদের কল্যাণে। সেই টাকায় পেট ভরে অসংখ্য শিশু ও বৃদ্ধবৃদ্ধার। দিন চলে কতশত গরিব মানুষের। ঈশ্বরের নাম করে বানানো প্রতিটা খাবার তাঁরা তুলে দেন সেসব শিশু আর দুঃস্থদের মুখে।
আরও শুনুন: উজ্জ্বল সম্প্রীতির ভারত, হিন্দুদের শোভাযাত্রায় জলের বোতল এগিয়ে দিলেন মুসলিম পড়শি
এই ইউটিউব চ্যানেলের জন্য় একদিন চাকরিবাকরি ছেড়ে চলে এসেছিলেন মইনুদ্দিন। অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুরে জন্ম তাঁর। তবে বড় হয়েছেন তেলঙ্গানায়। সেখান থেকে হায়দরাবাদে চাকরি। প্রায় ১২ বছর মিডিয়া জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মইনুদ্দিন। ২০১৭ সালে দুই বন্ধু শ্রীনাথ রেড্ডি ও ভগৎ রেড্ডির সঙ্গে মিলে খুলে ফেললেন নিজেদের একটি ইউটিউব চ্যানেল। নাম রাখলেন নবাব’স কিচেন। দিনে দিনে জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল তাঁর চ্যানেলের। একটা সময় দাঁড়ি পড়ল চাকরিতে।
বরাবরই রান্না করতে ভালবাসতেন মইনুদ্দিন। আপাতত ইউটিউবের ফুলটাইম কর্মী তিনি। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর দুই বন্ধুও। ইউটিউব থেকে হওয়া আয় কোনওদিনই নিজেদের জন্য জমাননি মইনুদ্দিনরা। বরং সেই টাকা দান করেছেন একাধিক অনাথ আশ্রম থেকে শুরু করে বৃদ্ধাশ্রম এবং দুঃস্থ মানুষের সাহায্যার্থে। গত পাঁচ বছরে অসংখ্য শিশুর মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন এই ত্রয়ী।
কীভাবে এল এই ভাবনা? মইনুদ্দিন জানিয়েছেন, ছোটবেলায় আম্মির সঙ্গে ট্রেনে যাওয়ার সময় একটি বাচ্চাকে জঞ্জাল থেকে খাবার কুড়িয়ে খেতে দেখেছিলেন তিনি। ছোট্ট মনে গভীর ছাপ ফেলে গিয়েছিল সেই ছবিটা। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, পকেটে কোনও দিনই বিশেষ টাকাপয়সা থাকত না। নিজের সেই দিনগুলোর কথা মনে করেই বাচ্চাদের জন্য কিছু করার ইচ্ছে হত তাঁর। অনাথআশ্রম বা দুঃস্থ শিশুরা বেশিরভাগ সময়ই আমিষ খাবারদাবার পায় না। ফলে শরীরে প্রোটিনের ঘাটতি থেকে যায়। সেই অভাবটা মেটাতেই এই উদ্যোগ শুরু করেন মইনুদ্দিনরা। মা-ঠাকুমাকে দেখে দেখেই রান্না আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। আর সেই সব রেসিপিই ইউটিউবে ভাগ করে নয় নবাবের রসুই। সপ্তাহে দুই থেকে তিন বার অনাথ আশ্রমগুলিতে খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করেন তাঁরা।
আরও শুনুন: কেউ যেন অভুক্ত না থাকে! ভক্তদের খাওয়াতে ভিক্ষার ১ লক্ষ টাকা মন্দিরে দান বৃদ্ধার
প্রাথমিক ভাবে তিন জনেই শুরু করেছিলেন চ্যানেলটি। প্রোডাকশন, জিনিসপত্রের জোগান থেকে শুরু করে রেসিপি নির্বাচন-সব কাজটাই দেখেন ভগৎ। শ্রীনাথ সামলান স্পনসরশিপের দিকটা। আর পর্দায় মন-প্রাণ ঢেলে রান্না করেন মইনুদ্দিন। তাঁরা ছাড়াও আরও ন’জন রয়েছেন এখন মইনুদ্দিনদের সঙ্গে। পাঁচ বছরে তাঁদের চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা প্রায় ২৬ লক্ষ। পাঁচ বছরে কয়েক কোটি ভিউ পেয়েছে তাঁদের ভিডিওগুলি। প্রাথমিক ভাবে অনাথআশ্রমের শিশুদের খাওয়ানোটাই লক্ষ ছিল তাঁদের। তবে করোনাকালীন সময়ে বাচ্চাদের কাছে যাওয়া, তাঁদের রেঁধেবেড়ে খাওয়ানোটা সম্ভব ছিল না। সেসময় বিভিন্ন ঝুপড়ি এলাকা, শ্রমিক কলোনিগুলিতে খাবারদাবার সরবরাহ করা শুরু করলেন মইনুদ্দিনরা। একটি হারিয়ে যাওয়া শিশুকে ঘরে ফেরাতেও সফল হয়েছেন তাঁরা ওই চ্যানেলের মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে দারুণ সাফল্য পেয়েছে তিন বন্ধুর এই ইউটিউব চ্যানেলটি। আর কিছু নয়, বাচ্চাদের মুখের ওই হাসিটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার বলে মনে করেন তিন বন্ধু। তাঁদের এই উদ্যোগে পাশে রয়েছেন মইনুদ্দিনের স্ত্রীও। স্বামী ও তাঁর বন্ধুরা মিলে মহাপুণ্যের কাজ করছেন বলেই বিশ্বাস তাঁর। আপাতত আরও একটা ইচ্ছে রয়েছে মইনুদ্দিনের। আদিবাসী বাচ্চাদের জন্য একটি স্কুল খুলতে চান তিনি। আপাতত সেটার দিকে তাকিয়েই দিনরাত এক করে খাটছেন তিন বন্ধু।