পরীক্ষাগারে সৃষ্টি করা হল ডায়ার উলফ প্রজাতির তিন শাবক। ঠিক যেন হলিউডের ‘জুরাসিক পার্ক’-এর বাস্তব অনুকরণ, যেখানে দেখানো হয়েছিল যে দীর্ঘ গবেষণার দরুন ডাইনোসরেরা নতুন করে ফিরে এসেছে মানুষের পৃথিবীতে। সত্যিই কি এমনটা করা প্রকৃতির সঙ্গে কাঁটাছেড়া করা হয়ে যায় না?
প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে বিজ্ঞান। ফিরে এসেছে অধুনা বিলুপ্ত ‘ডায়ার উলফ’ প্রজাতির তিন শাবক। দুধ-সাদা শাবক তিনটিকে দেখলে রীতিমত বিস্মিত হতে হয়। ঠিক যেন জনপ্রিয় ‘গেম অফ থ্রোন্স্’ টেলিভিশন সিরিজের স্টার্ক পরিবারের অনুগত নেকড়ের দলের সদস্য তারা। আর সে জন্যই একটি শাবকের নাম রাখা হয়েছে ওই সিরিজটির সুপরিচিত এক চরিত্র ‘খালিসি’-র নামে। পুরুষ শাবক দুটির নাম রাখা হয়েছে রোমুলাস ও রেমাস। এই নাম দুটির উৎস আবার রোমের লোককথা; প্রচলিত রয়েছে, রোমুলাস ও রেমাস নামের দুই মানবশিশুকে নাকি নিজের স্তন্য পান করিয়ে বাঁচিয়েছিল এক নেকড়ে। দুই ভাই বড় হয়ে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের স্থাপনা করেন।
ডায়ার উলফের ফিরে আসা যে বিজ্ঞানের যুগান্তকারী প্রচেষ্টা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘ডায়ার উলফ’, যার আক্ষরিক অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘ভয়াবহ নেকড়ে’। তুষারযুগের পৃথিবী জুড়ে ছিল এই নেকড়েদের অবাধ বিচরণ। CRISPR নামক জিন প্রযুক্তির ব্যবহার করে, বর্তমানের গ্রে উলফের জিনগত সহায়তায়, এই শাবকদের জন্ম। আমেরিকার বিভিন্ন এলাকা থেকে খননকাজে পাওয়া ডায়ার উলফের কঙ্কাল ও দাঁতের ফসিল এ কাজে বড় ভূমিকা নিয়েছে। সাধারণ স্ত্রী কুকুরকে সারোগেট হিসেবে ব্যবহার করেই বিজ্ঞানীরা ফিরিয়ে এনেছেন এই ‘ডায়ার উলফ’ প্রজাতি।
এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছে নেটিজেনরা। কৌতূহল এই মুহূর্তে তুঙ্গে। কেউ কেউ সেগুলিকে নিজের চোখে একবার দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। সকলেই তারিফ করছেন বিজ্ঞানীদের। তা স্বাভাবিকই বটে। এ তো সিনেমাকেও হার মানায়। ঠিক যেন হলিউডের ‘জুরাসিক পার্ক’-এর বাস্তব অনুকরণ, যেখানে দেখানো হয়েছিল যে দীর্ঘ গবেষণার দরুন ডাইনোসরেরা নতুন করে ফিরে এসেছে মানুষের পৃথিবীতে।
তবে, দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, শাবকগুলোকে স্বচক্ষে দেখবার সুযোগ কারোর ভাগ্যেই জুটবে না তেমন। কেন? কারণ সেগুলোর জন্মই হয়েছে গবেষণার জন্য। তাদের শরীরের গঠন, মানসিক স্থিতি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, জিনগত অবস্থা – সবটাই এখন পরীক্ষার বিষয়। পদে পদে হিসেব রাখতে হবে, তাই ডায়ার উলফ শাবকগুলোকে আজন্মের মতো রাখা হবে এনক্লোজারে। তা ছাড়া, প্রাচীন যুগে ডায়ার উলফেরা যে প্রাণীগুলিকে শিকার করে খেত, যেমন ম্যাস্টোডন, জায়ান্ট শ্লথ বা এনশিয়েন্ট বাইসন, সে সবই বর্তমানে অবলুপ্ত। ফলে আপাতভাবে খাওয়ার জন্য মানুষের উপর নির্ভর করতেই হবে এই শাবকদের, কিংবা আগামী দিনে মেনে নিতে হবে মানুষের নির্ধারিত খাদ্যাভ্যাস। তা ছাড়া বর্তমান পৃথিবীর রোগ জীবাণু আর দূষণের মধ্যে আদৌ কি প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে পারবে এই তুষার যুগের বাসিন্দারা? প্রশ্ন থেকেই যায়।
আমরা যারা ‘জুরাসিক পার্ক’ ফ্র্যাঞ্চাইজির সিনেমাগুলো দেখেছি, তারা সকলেই জানি যে প্রকৃতির বিপক্ষে গিয়ে ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনার ঠিক কী পরিণতি সইতে হয়েছিল মানুষকে। যত্ন করে তৈরি ‘পার্ক’-এর ধারণা ধুলিসাৎ করে দিয়ে বারংবার মানুষ-ডাইনোসরের সংঘাত বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, প্রতিটি প্রজাতির জন্য যে নির্দিষ্ট যুগ ধার্য করেছে প্রকৃতি, তা যথাযথ। নইলে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তবুও মানুষ থামতে পারে না। হয়তো নিজের বেলায় শেষ চাল পালটে দেওয়া যাবে, এমন ভাবনা থেকেই ক্রমাগত দুঃসাহসী হয়ে ওঠে।
ডায়ার উলফ শাবকগুলোর পুনরায় ফিরে আসার পিছনে মূল দায়িত্বে রয়েছে যে সংস্থাটি, সেটির ওয়েবসাইট খানিক কাব্যিক ভাষায় জানায় যে, তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হল ‘প্রকৃতির সুপ্রাচীন হৃদস্পন্দন পুনরায় চালু করা’। সত্যিই কি এমনটা করা প্রকৃতির বিপক্ষেই যাওয়া হবে না? বিজ্ঞান-ই বলে, প্রকৃতি কখনও শূন্যস্থানের পক্ষপাতী নয়। যখন সে কোনও প্রাণীকে অবলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়, তখন সযত্নে সেই শূন্যতা ভরে দেয় নতুন কোনও প্রজাতি দিয়ে। প্রয়োজনে সেইমতো বদলে দেয় আবহাওয়া, জলবায়ু। এই অবস্থায় যে সকল প্রজাতি প্রাকৃতিক নিয়মেই মুছে গেছে, তাদের জোর করে ফিরিয়ে আনা কি খোদার উপর খোদগারি হয়ে যায় না? সদ্যোজাত প্রাণীগুলি যে অচিরে প্রাণ হারাবে না, বা আচমকা জিনগত কারণেই ভয়াবহ কোনও পরিবর্তন ডেকে আনবে না, তা নিশ্চিত করতে পারে না কেউ। তাছাড়া বর্তমানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকা সারোগেট মা কুকুরগুলোও নতুন কোনও জীবাণু বহন করছে কি না, তা জানতে পারা এখন সময়ের অপেক্ষা।
যদিও বিজ্ঞানীরা যে লক্ষ্যে এই শাবকগুলো ফিরিয়ে এনেছেন, সেই পরীক্ষার গণ্ডীতেই ডায়ার উলফের বিচরণ সীমাবদ্ধ থাকলে, হয়তো ভয়ের কিছু নেই। তবু পুরনো সময়, পুরনো প্রাণ ফিরে এলে পুরনো বিপদ ফিরে আসবে কি-না সে শঙ্কা থেকেই যায়। আর তাই মানুষের কাজ যাতে মানবসভ্যতা আর প্রকৃতির পরিপন্থী না হয়ে ওঠে, সে সচেতনতার দায় সমগ্র মানুষজাতিরই।