আমাদের অজান্তে কখন যেন আমরা গোলাপি রংকে একাত্ম করে ফেলেছি যা কিছু নরম, কমনীয়, নারীসুলভ, তার সঙ্গে। এর বিপরীতে, ‘ইন্টারন্যাশানাল ডে অফ পিঙ্ক’-এর একমাত্র লক্ষ্য হল, প্রান্তিক মানুষদের হীনমন্যতার ঘেরাটোপ থেকে বের করে এনে সামগ্রিকের অংশ করে তোলা।
ছোট থেকেই আমাদের বলে দেওয়া হয়, গোলাপি মেয়েদের রং। যেমন নীল ছেলেদের। মেয়েদের পোশাক, নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী সবেতেই তাই প্রায়শই গোলাপি রঙের ব্যবহার চোখে পড়ে। এমনকি জনপ্রিয় ‘বার্বি’ পুতুলের ক্রেতা মূলত অল্পবয়সী মেয়েরা হওয়ায়, বার্বির পরনের জামা, বার্বির প্রতিটি ‘অ্যাক্সেসারি’ই গোলাপি রঙে রাঙানো হয়। বার্বির পৃথিবী, যা বিশ্বের বিপুল সংখ্যক বাচ্চা মেয়েদের স্বপ্নের জগৎ বলা চলে, তার রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বাড়িঘর সমস্ত কিছুর রংই হালকা গোলাপি।
আর এভাবেই আমাদের অজান্তে কখন যেন আমরা গোলাপি রংকে একাত্ম করে ফেলেছি যা কিছু নরম, কমনীয়, নারীসুলভ, তার সঙ্গে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রীতিমতো ভয়াবহ হয়েছে ওঠে এই পক্ষপাতিত্ব। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অন্য ছেলেদের চোখে যাতে তাকে দুর্বল না দেখায়, তাই পৌরুষ খর্ব হওয়ার ভয়ে অনেক ছেলেই গোলাপি পোশাক বা জিনিস এড়িয়ে চলে। ইয়ার্কির ছলে যা কিছু গোলাপি, তাই কোমল বলে দেগে দেওয়ার প্রবণতা চারিপাশে একটু চোখ রাখলেই অজস্র দেখতে পাই আমরা।
২০০৭ সালে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল কানাডার নোভা স্কোটিয়া এলাকার একটি স্কুলে। হাই স্কুলের ছাত্র ডেভিড শেফার্ড ও ট্রাভিস প্রাইস একদিন স্কুলে এসে দেখতে পান, একদল গুন্ডাগোছের ছেলেপিলে মিলে ঘিরে ধরেছে তাদেরই এক সমকামী সহপাঠীকে। রীতিমতো হেনস্তা করছে সকলে মিলে। ছেলেটির অপরাধ যে, সে গোলাপি জামা পরে এসেছে। গোলাপি, অর্থাৎ দুর্বল। অতএব যেমনভাবে ইচ্ছে তাকে কোণঠাসা করা যেতে পারে। এই ঘটনা ডেভিড ও ট্রাভিস-কে ভীষণরকম আহত করে এবং তারা তৎক্ষণাৎ এর প্রতিবাদে জড়ো করতে থাকে স্কুলের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের। ফলস্বরূপ এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পাওয়া গেল পরের দিন। সকলকে অবাক করে দিয়ে পরের দিন এক মিছিল বেরোল স্কুল জুড়ে, যেখানে লিঙ্গ ব্যতিরেকে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী যোগ দিয়েছিল কেবলমাত্র গোলাপি পোশাক পরে।
দুই স্কুলপড়ুয়ার এমন সাহসের গল্প মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র বিশ্বের দরবারে। আগামী দিনে এর সূত্র ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ক্যানাডিয়ান সেন্টার ফর জেন্ডার অ্যান্ড সেক্সুয়াল ডাইভারসিটি’। প্রচলন শুরু হল ‘পিঙ্ক শার্ট ডে’ এবং ‘ইন্টারন্যাশানাল ডে অফ পিঙ্ক’-এর। প্রতি বছর এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় বুধবারটিকে বেছে নেওয়া হল এই উদযাপনের জন্য। এই হিসাবে চলতি বছরে ৯ এপ্রিল হল ‘ইন্টারন্যাশানাল ডে অফ পিঙ্ক’; তবে, কেবল একটি বিশেষ রঙের পোশাক পরলে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটা করে পোস্ট দিলে এ উদযাপন সম্পূর্ণ হয় না। বরং খেয়াল রাখতে হয় সেই উদ্দেশ্যগুলি, যা মাথায় রেখে দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশানাল ডে অফ পিঙ্ক’-এর একমাত্র লক্ষ্য হল, শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে হোমোফোবিয়া (সমকামী মানুষদের প্রতি ঘৃণা), ট্রান্সফোবিয়া (রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি ঘৃণা) নির্বিশেষে সমস্তরকম ঘৃণার অবসান ঘটানো। প্রান্তিক মানুষদের হীনমন্যতার ঘেরাটোপ থেকে বের করে এনে সামগ্রিকের অংশ করে তোলা। তাঁদের একাকীত্ব ঘুচিয়ে সাধারণ জীবনের অংশ হিসাবে শামিল করে নেওয়া। এবং, যে কোনওরকম হেনস্তা বা ‘বুলি’র বিরুদ্ধে সরব হওয়া। আমাদের ভুললে চলবে না যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বুলি’ বা ‘র্যাগিং’ কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশ বা রাজ্যের সমস্যা নয়। প্রতি বছর সারা বিশ্ব জুড়ে অগণিত পড়ুয়া কেবল অন্যদের থেকে নিজেকে দলছুট অনুভব করে হারিয়ে যায়, সরে আসে। ক্ষেত্রবিশেষে আত্মহননের পথও বেছে নেয় ।
অতএব গোলাপি হয়ে উঠল অন্তর্ভুক্তির রং, বৈচিত্র্যের রং, সাহস, সংবেদনশীলতা, সহানুভূতি, ও স্বীকৃতির রং। ‘রং’-এর সামান্য পরিধি ছাড়িয়ে যা বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে এক আন্দোলনের চেহারা নিয়েছে। যে কোনওরকম প্রান্তিক মানুষদের প্রতি যে পুঞ্জীভূত ঘৃণা, বিদ্বেষ উগরে দেয় ‘মেইনস্ট্রিম’ সমাজ, গোলাপি যেন তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা এক দৃঢ় কণ্ঠস্বর।