হিজাব বিতর্কে কিছুদিন আগেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল কর্ণাটক। উঠে এসেছিল সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের একের পর এক অভিযোগ। তবে সেই ছবিটাই রাজ্যের সামগ্রিক চিত্র নয়। কর্ণাটকের মাটিতে আছে সম্প্রীতির নিদর্শনও। আর তাই সেখানে হিন্দুরাই পালন করেন মহরম। আসুন শুনে নিই, কর্ণাটকের এই ব্যতিক্রমী উৎসব পালনের কথা।
মাঝেমধ্যেই সাম্প্রদায়িক হানাহানি, হিংসার খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তবে সে সবের আঁচ পৌঁছয় না কর্ণাটকের বেলাগাভি জেলার হিরেবিদানুর গ্রামে। এ সময়টা নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না গ্রামবাসীর। হবে না-ই বা কেন! মহরমের আয়োজন বলে কথা, হাজার রকম কাজ লেগেই থাকে। গ্রামটিতে প্রায় হাজার তিনেক লোকের বাস। তবে গ্রামবাসীদের কেউই ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন। তাই বলে এতদিনকার ঐতিহ্যে ছেদ পড়বে, তা আবার হয় নাকি! তাই মহরম পালনে এগিয়ে আসেন হিন্দু বাসিন্দারাই। পাঁচ দিনের এই অনুষ্ঠানে শামিল হয় গোটা গ্রাম।
আরও শুনুন: ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হল ১৫ আগস্টকে, নেপথ্যের কারণ কী?
এ গ্রাম বরাবরই যে এমন মুসলিম-শূন্য ছিল, তা কিন্তু নয়। এককালে এখানে মিলেমিশে বাস করতেন হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষই। আর সেই ইতিহাসই বহন করে আসছে এখানকার ফকিরেশ্বর স্বামীর মসজিদ। বহু দিন আগে দুই মুসলিম ভাই ওই মসজিদটি স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর পর সেই মসজিদের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন গ্রামবাসীরাই। সেই থেকে তাঁদের হাত ধরেই পালিত হয় সমস্ত পরব, অনুষ্ঠান। এক হিন্দু পুরোহিত নিয়ম করে মসজিদে আসেন। হ্যাঁ, তিনি নিজের ধর্মমতেই প্রার্থনা করেন আল্লাহ্র। এ নিয়মের অন্যথা হয়নি কখনও। প্রার্থনা সারতে মসজিদে আসেন গ্রামবাসীরাও।
তবে মহরমের সময়টা যেন অন্যরকম। এ সময় অন্য সাজে সেজে ওঠে গোটা গ্রাম। পাশের গ্রামের এক মৌলবি টানা এক সপ্তাহ ওই মসজিদের ভিতরেই বসবাস করেন। ইসলাম ধর্মমতে নিষ্ঠা মেনে প্রার্থনা সারা হয় ওই কটা দিন। গ্রামে বসে বিরাট মেলা। পাঁচ দিনের সেই মেলায় জড়ো হয় গোটা গ্রাম। ভিড় করেন লোকশিল্পীরা। চলে অনুষ্ঠান। বেরোয় পদযাত্রাও। টর্চ হাতে গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন গ্রামবাসী।
আরও শুনুন: পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিচ্ছেন ভারতীয়রা! ইঙ্গিত মিলছে তথ্যে, কারণটা কী?
ইসলামিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী রমজানের পরে অন্যতম পবিত্র সময় হিসেবে ধরা হয় এই মহরমের সময়টাকেই। এই অনুষ্ঠান তাঁদের কাছে আনন্দের নয়, বরং শোকপালনের। কারবালার যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করেছিলেন হজরৎ মহম্মদের প্রপৌত্র। সেই শোকের আবহেই পালন করা হয় এই পরব। ধর্ম আলাদা হওয়া সত্ত্বেও নিষ্ঠার সঙ্গে পরব পালনে কোনওদিন কুণ্ঠাবোধ করেনি কর্ণাটকের এই গ্রাম। আসলে মন্ত্র যা-ই হোক না কেন, আসল কথা বোধহয় ভক্তি। আর যে প্রার্থনার সঙ্গে সেই ভক্তি মিশে থাকে, তা সর্বশক্তিমানের কাছে পৌঁছতে সময় লাগে না। ঈশ্বর বা আল্লাহ্র- মধ্যে তাই কোনও ভেদাভেদ নেই গ্রামবাসীদের বিশ্বাসে। সমস্ত ধর্মবিশ্বাস ও আচারের ঊর্ধ্বে উঠে ঐতিহ্যের মশালকে জ্বালিয়ে রাখতে ভুল করেননি এ গ্রামের মানুষজন। আর এই বৈশিষ্ট্যই গ্রামটিকে করে তুলেছে ব্যতিক্রমী।