শুধু মুখের কথা নয়, সত্যি করেই চাকরি হারানো কর্মচারীদের নতুন কর্মক্ষেত্র খুঁজে দিলেন সিইও। দু-একজন বাদে প্রত্যেকে নতুন চাকরি পেয়ে গেল নোটিস পিরিয়ডের মধ্যেই। যারা পেল না, তাদের কোম্পানি দিল বাড়তি দুই মাসের বেতন। এমতাবস্থায় কী করবেন আপনি? সিইও মহাশয়কে কি স্বয়ং ঈশ্বরপ্রেরিত দূত ভাবতেই ইচ্ছে করবে না?
আচমকা চাকরি খুইয়েছেন? সমস্যা কী! নতুন চাকরি খুঁজে দেবেন প্রাক্তন কোম্পানির সিইও-ই!
শুনতে গল্পের মতো হলেও, এ আসলে সত্যি। আর এ-গল্পই যেন ইঙ্গিত দিছে কর্পোরেটে ভাল সিইও-খারাপ সিইও দ্বন্দ্বের।
ছাঁটাই শব্দটি বর্তমান সময়ের যে কোনও কর্মীর কাছেই পরিচিত। সে তিনি যতই উচ্চপদস্থ হন না কেন, বিশেষত বেসরকারি সংস্থায় যে ছাঁটাইয়ের কোপ নেমে আসতে পারে, তা সকলেই জানেন। সংস্থার লাভ-লোকসানের হিসাব বদলে গেলে, কোপ এসে পড়ে কর্মীদের উপরেই। তবে, যে সংস্থা ছাঁটাই করছে, সেই সংস্থারই সিইও ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের নতুন চাকরি খুঁজে দিচ্ছেন, এমনটা সচরাচর চোখে পড়ে না।
এমন ঘটনা শুনতে প্রায় অবাস্তব লাগলেও, আদতে যে মিথ্যে নয়, তার উদাহরণ বেঙ্গালুরুর একটি কোম্পানি। কোম্পানির সিইও-র করা একটি পোস্ট সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি নিজেই বিষয়টি জানিয়েছে। জানিয়েছেন যে, দ্রুততার সঙ্গে কর্মী নিয়োগ করতে গিয়ে তাঁদের ভুল হয়েছিল। সে কারণে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। কর্মীদের ছাঁটাই করা ছাড়া তাঁর হাতে আর কোনও উপায় ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই তিনি এ কাজ করেছেন। তবে, এখানেই শেষ নয়। ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের কাজের ব্যবস্থাও তিনি করেছেন। সংস্থার সিইও জানিয়েছেন যে, ৭০জন কর্মীর সঙ্গেই ব্যক্তিগতভাবে তিনি কথা বলেছেন। তিন মাস সময়ের মধ্যে যা যা করা সম্ভব, সবটুকু দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। ৬৭জন ইতিমধ্যেই চাকরি পেয়েও গিয়েছেন। বাকি তিনজনকে বাড়তি দুই মাসের বেতন দেওয়া হয়েছে। এরপরই তিনি তুলেছেন মোক্ষম প্রসঙ্গ। বহু কর্মীই গত এক বছরে চাকরি হারিয়েছেন। কাউকে হয়তো ঠিকমতো জানানোও পর্যন্ত হয়নি যে, কেন তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কাউকে আচমকা ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে। এমনটা নেহাতই অমানবিক। তাঁর তাই প্রশ্ন, নিয়োগের সময়ে যদি কর্মীকে ‘পরিবার’ বলে ডাকা হয়, তবে শেষ দিন পর্যন্ত সেই পারিবারিকতা বজায় থাকাই তো বাঞ্ছনীয়।
স্বাভাবিক ভাবেই, এই সিইও-র মানবিক কাজ নিয়ে দিকে দিকে প্রশস্তি। চাকরিহারাকে চাকরি খুঁজে দেওয়া প্রশংসার দাবি রাখে ঠিকই; তবে তা কখনওই এ ভাবনাকে পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারে না যে, এই অবস্থার প্রাথমিক দায় কোম্পানিটিরই। নিয়োগজনিত হঠকারিতা না থাকলে কর্মীদের এই বিপদের মুখে পড়তে হত না। তা ছাড়া, চাকরি হারানো ব্যক্তিরা যে নতুন সংস্থাগুলোয় গেলেন, সেগুলোই বা কতখানি দীর্ঘমেয়াদের আশ্বাস দিতে পারে? এই আচমকা ছাঁটাইয়ের ঘটনা যদি চিরকালীন কোনও ক্ষতিসাধন করে থাকে, যা কর্মচারীরা টের পাবেন আরও কিছুদিন পর, সেক্ষেত্রে সে দায় নেবে কে? এ সমস্ত একপাশে সরিয়েও যদি রাখা যায়, তবু ভাবনার কাঁটা থেকে যায় সেই তিনজন ব্যক্তিকে নিয়ে, যাঁরা চাকরি পেলেন না। বাকি ৬৭ জনকে দেখে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা নিজেরাই! দুই মাসের বাড়তি বেতন কি সে অস্বস্তি ভুলিয়ে দিতে সক্ষম? অথচ, তাঁরা তো বাকিদের সঙ্গেই চাকরি পেয়েছিলেন, করছিলেন এতদিন!
আর এখানেই খানিকটা প্রশ্নের মুখে পড়ে সিইও-র ভূমিকা। কোম্পানির স্বার্থ তিনি রক্ষা করেছেন সংস্থার কাছে ভালো সিইও হয়ে। আবার ব্যক্তিগত ভাবে চাকরিহারাদের চাকরি পাইয়ে দিয়ে মানবিক হওয়ারও চেষ্টা করেছেন। তবে, এসবই ব্যক্তিগত উদ্যোগ। ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের যে তিনি চাকরি দিতে পারতেনই, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। বরং এই ধরনের পরিস্থিতির দরুন, কর্মীদের যে সব প্রশ্নের মুখে পড়তে হত সংস্থাকে, তাই-ই তিনি আড়াল করে দিয়েছেন। অধিকার আদায়ের জন্য কর্মীরা জোট বাঁধতে পারতেন। দাবি আদায় করে নিতেও পারতেন। সেই ঐক্যই সুকৌশলে ইনি ভেস্তে দিয়েছেন। যা মানবিকতার নমুনা বলে মনে হচ্ছে, তা আদতে মানুষকেই একজোট হতে দিল না। সংস্থার কাছে ‘সেফটি ভালভ’ হয়েই থেকে গেলেন এই সিইও।
সকলে তা করেন না। তাই অনেকেই খারাপ সিইও বদনাম কুড়োন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ভালো-মন্দের ধারণাই এখানে বেশ গোলমেলে। আর সেই গোলমালের ভিতর মানুষ ভুলে যাচ্ছে তার হকের কথা বলতে। বছরভর কাজ করে, সংস্থার হঠকারিতায় যে কর্মীর চাকরি গেল, তিনি তো প্রশ্ন করতেই পারতেন, চাকরি কেন গেল? সে প্রশ্ন তিনি করতে পারলেন না তথাকথিত মানবিক ভালো সিইও-র কল্যাণে। তাহলে তিনি আদতে ভালো না মন্দ সিইও। তা বিবেচনার ভার তোলা থাকল সময়ের উপরই।