কারোর প্রতি ভাললাগা, ভালবাসা বা স্নেহ বোঝাতে তো আজকাল আমরা চট করে মোবাইলের ইমোজি সেকশন থেকে একটা লাল রং-এর হার্ট সাইন টুক করে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু জানেন কি, এর উৎপত্তির ইতিহাস? ভালবাসার প্রকাশ কেন লাভ সাইনকেই ছুঁয়ে ফেলল, আসুন শুনে নেওয়া যাক সেই ইতিবৃত্ত।
পৃথিবীর পবিত্রতম অনুভূতি কোনটি? এই প্রশ্ন যদি করা হয় , দেখা যাবে ১০০ জনের মধ্যে ৯৫ জনই বলছেন ‘ভালবাসা।। এই ‘ভালবাসা’র প্রকাশ যদিও এক এক জনের কাছে এক এক রকম। তবে সাংকেতিক ভাবে আমরা কিন্তু ভালবাসা বলতে বর্তমানে একটি ‘চিহ্ন’ বুঝি। সম্প্রতি সেই চিহ্নটি আবার চর্চায় উঠে এসেছে। সৌজন্যে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের প্রতি তিনি নাকি এই সাংকেতিক চিহ্ন দেখিয়েই ভালবাসা জানিয়েছেন। যা নিয়ে তুমুল শোরগোল পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এখন তো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ভালবাসা প্রকাশ করতে নির্দিষ্ট লাভ সাইন ইমোটিকনও আছে। এছাড়া কোথাও কমেন্ট করতে গিয়ে হোক বা কাউকে মেসেজ পাঠানোর ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই এই ‘লাভ সাইন’ ব্যবহার করি । প্রেম ,ভালোবাসার বা স্নেহের প্রতীক হিসেবে এই চিহ্নের স্বীকৃতি সারা বিশ্বে বহু শতাব্দী ধরেই। তবে ভি-আকৃতির বেস-সহ ডবল-স্ক্যাল্পড্ আইডিওগ্রামটি যে বরাবরের জন্য ছিল না, সেটা বিশ্বাস করা হয়তো বর্তমান প্রজন্মের কাছে একটু কঠিন হতে পারে। কারণ এই হার্ট-সাইন আধুনিক প্রজন্ম এত ব্যবহার করে যে, এর অস্তিত্ব ছিল না ভাবতে তাদের কষ্টই হবে। দেখা গিয়েছে, সর্বাধিক ব্যবহৃত ইমোজিগুলির মধ্যেও একটি হল লাভ সাইন। এখন প্রশ্ন, এহেন একটা সর্বজনীন প্রতীক ,যা আমরা প্রায়শই আমাদের ভালোলাগা ,ভালোবাসা , স্নেহ ইত্যাদি প্রকাশ করতে ব্যবহার করি তার উৎপত্তি ঠিক কোথায়?
আরও শুনুন: ফুলেরও আছে নিজস্ব ভাষা, লাল গোলাপ কেন ভালবাসার কথা বলে জানেন?
ইতিহাস বলে, প্রাচীন সমাজে অলংকার শিল্পে থেকেই এই হৃদয়ের আকৃতি ব্যবহারের সূত্রপাত। আর এর প্রাচীনতম নমুনা মেলে সিন্ধু সভ্যতায়। সেটি হল একজোড়া কানের দুল। সেটি ছিল হৃদয়-আকৃতির। যার সাদৃশ্য মেলে ডুমুর পাতার সঙ্গে। আইভি, ডুমুর এবং জল-লিলির পাতাগুলি শিল্পকর্মে বহুল ব্যবহৃত হত। বিশেষ করে আইভি পাতাকে বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসাবে মান্য করা হত। মনে করা হয়, প্রকৃতির বুকে এই যে চিহ্নসমূহ ছড়িয়ে ছিল, তারই প্রভাব পড়েছে তখনকার শিল্পকর্মে। সেগুলিকেই আজকের লাভ সাইনের আদিরূপ বলা যেতে পারে। উদ্ভিদ বা প্রকৃতি থেকেই যে এর উৎপত্তি তার সমর্থন মেলে আরও একটি তত্ত্বে। উত্তর আফ্রিকার সিরিনে পাওয়া যেত ‘সিলফিয়াম’ নামে এক উদ্ভিদ। গর্ভনিরোধক হিসাবে এই উদ্ভিদের প্রয়োগ ছিল তৎকালীন সমাজে। এর যে বীজ, তার আকৃতি ছিল অনেকটা লাভ সাইনের মতোই অর্থাৎ হৃদয়াকৃতির। যৌনতার সঙ্গে এই সম্পর্ক থাকার দরুন, ভালবাসার সঙ্গে হার্ট-শেপের যোগ এসেছে বলেও অনেকে মনে করেন।
আরও শুনুন: কমবয়সি মেয়েদের সঙ্গে প্রেমের ঝোঁক, পুরুষদের প্রবণতাকে তুলোধোনা মিয়া খালিফার
আবার কেউ কেউ মনে করেন হৃদয়-আকৃতি হল মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি। অর্থাৎ স্তন, নিতম্ব বা যৌনাঙ্গের বিশেষ আকৃতির প্রতিনিধিত্ব করে এই চিহ্ন। আবার অনেকের মতে ‘হার্ট সাইন’ প্রাচীন দার্শনিকদের মতবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত, যাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, হৃদয় হল আত্মার আসন এবং আবেগের প্রাণকেন্দ্র। ঘটনাচক্রে মানুষের হৃদপিণ্ডের আকৃতি যখন ব্যাখ্যা করলেন চিকিৎসকরা, তখন ২-এ ২-এ চার একরকম হয়েই গেল। অর্থাৎ ভালবাসার সঙ্গে হৃদয়ের একরকমের যোগসূত্র স্থাপন হয়ে গেল। এর নেপথ্যে থেকে গেল সেই প্রকৃতি থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা, যৌনতার সূত্র, দার্শনিকদের মতবাদ আবার চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতিও। বিভিন্ন ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে মিশিয়েই সামাজিক জীবনে এই চিহ্ন গুরুত্ববাহী হয়ে উঠল।
আরও শুনুন: হাঁটু মুড়ে করা হয় প্রেম নিবেদন, এই প্রথার নেপথ্যে কী কারণ?
তবে এই হার্ট সাইনের ব্যবহার অলংকার শিল্পে জনপ্রিয় হলেও ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রেমের বা ভালবাসার সঙ্গে এর সংযোগ তেমন দৃঢ় হয়ে উঠতে পারেনি। প্রেমের প্রতীক হিসাবে হৃদয়-আকৃতির প্রথম পরিচিত চিত্রটি সম্ভবত দেখা যায় ১২৫০-এ, ফরাসি চিত্রকলায়। যেখানে দেখা যায় এক যুবক তাঁর দয়িতার প্রতি হৃদয়-আকৃতির একটি প্রতীক নিবেদন করছে। এদিকে এই চিহ্নের উৎস যে প্রভু যিশু, তা প্রমাণে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন খ্রিস্টান যাজকরাও। এর পর সপ্তদশ শতাব্দীতে ভ্যালেন্টাইনস ডে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই সময় প্রেমিক প্রেমিকারা চিঠি পাঠাতেন একে অপরকে যা প্রায়শই ওই হার্ট সাইন দিয়ে সাজানো থাকত। মোটামুটি এই সময় থেকেই ভালবাসা প্রকাশের সাংকেতিক চিহ্ন হয়ে উঠল লাভ সাইন। সময় যত গড়িয়েছে, তত এর ব্যবহারিক পরিবর্তন এসেছে। এখন যেমন সোশ্যাল মিডিয়ায় লাভ সাইন ব্যবহারের ছড়াছড়ি। তবে কথা না বলে ভালবাস প্রকাশের এটাই যে যে আদিতম ভাষা, তা বোধহয় বলাই যায়। আর সে ভাষায় মনের কথা জানাতে আজও যে কসুর করে না মানুষ, সে প্রমাণ তো সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকেই মিলছে।