নিরীহ একজন মানুষ খুন হবেন কেন? বেজায় ধন্দে পড়ল প্যারিস পুলিশ। এটা যে সময়ের গল্প, তখনও হাতের ছাপ থেকে আততায়ীকে চেনার পদ্ধতি সর্বত্র প্রচলিত হয়নি। ইংরেজ পুলিশের দৌলতে এর প্রচলন হয়েছিল ঔপনিবেশিক ভারতে। কিন্তু ইংরেজদের আবার তেমন পাত্তাই দিতেন না ফরাসিরা। ফলে ফিঙ্গার প্রিন্ট ইত্যাদি সংগ্রহের আর ধার ধারলেন না তাঁরা।
ডেস্কের পাশে পড়ে রয়েছে একটি মৃতদেহ। মাথার পাশে চাপচাপ রক্ত। পাশেই পড়ে একটা ভারী পেপারওয়েট। বোঝা যাচ্ছে, ওইটি দিয়েই খুন করেছে আততায়ী। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার দ্রুত একবার ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। ছাপোষা একটা অ্যাপার্টমেন্ট। ঘরের এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা জিনিস। একা মানুষের ঘর যেমন হয়। প্রতিবেশীরাই এই খুনের খবর দিয়েছিল পুলিশকে। তাঁদের অনেকেই বলছেন, ভদ্রলোক বেজায় মিশুকে। একেবারে অমায়িক মানুষ যাকে বলে। শত্রু বলতে কেউ নেই। সেই মানুষই আচমকা একদিন খুন গেলেন! ভাঁজ পড়ল পুলিশ অফিসারের ভুরুতে। আবারও তাকিয়ে দেখলেন ঘরটার ভিতর। দেখলেন, ঘরের মধ্যে ওই একটাই ডেস্ক। যার পাশে এখন পড়ে আছে শবদেহটি। ডেস্কের ড্রয়ারটা আধখোলা। তল্লাশি চালিয়ে দেখা গেল, সেখানে সোনার গয়না, হিরে লাগানো সোনার ঘড়ির মতো বহু মূল্যবান জিনিসই রয়েছে। কেউ তা নাড়াঘাঁটা করেছে বলে তো মনে হল না। তাহলে? কেন খুন হলেন ভদ্রলোক? খুনের উদ্দেশ্যটা প্রাথমিক ভাবে কিছুতেই ধরতে পারল না পুলিশ।
আরও শুনুন: গভীর রাতে দোতলার জানলায় ফিরে ফিরে আসে এক ছায়ামূর্তি…
প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথাবার্তায় ভদ্রলোক সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানা গেল। ভদ্রলোকের নাম গ্যাস্টন লেরু। একাই থাকতেন এই অ্যাপার্টমেন্টে। হ্যাঁ, সকলে একবাক্যে তাঁকে দরাজ সার্টফিকেট-ই দিচ্ছেন। বলছেন, উনি তো দিলখোলা মানুষ। নিহতের আরও এক গুণের কথা জানতে পারল পুলিশ। ভদ্রলোক মাঝেমধ্যেই পড়শিদের নিমন্ত্রণ জানাতেন তাঁর ঘরে। তিনি আবার ডাকটিকিট জমাতে খুব ভালোবাসতেন। আর পড়শিদের ডেকে ডেকে সেই টিকিটের মজার গল্প শোনাতেন। এক এক জন তো এতবার করে সেই সব গল্প শুনেছেন যে প্রায় মুখস্থই হয়ে গিয়েছে ডাকটিকিটের ইতিহাস।
আরও শুনুন: কিশোরীদের রক্তে স্নান, ৬০০ জনকে খুন, কুখ্যাত মহিলা সিরিয়াল কিলারের রুদ্ধশ্বাস গল্প
এমন নিরীহ একজন মানুষ খুন হবেন কেন? বেজায় ধন্দে পড়ল প্যারিস পুলিশ। এটা যে সময়ের গল্প, তখনও হাতের ছাপ থেকে আততায়ীকে চেনার পদ্ধতি সর্বত্র প্রচলিত হয়নি। ইংরেজ পুলিশের দৌলতে এর প্রচলন হয়েছিল ঔপনিবেশিক ভারতে। কিন্তু ইংরেজদের আবার তেমন পাত্তাই দিতেন না ফরাসিরা। ফলে ফিঙ্গার প্রিন্ট ইত্যাদি সংগ্রহের আর ধার ধারলেন না তাঁরা। প্রতিবেশীদের কথা অনুযায়ী খুঁজে দেখা গেল, সত্যি ভদ্রলোকের সংগ্রহে আছে বহু ডাকটিকিট। সেগুলো সব গুছিয়ে অ্যালবাম করেও রাখা আছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় খোয়া যায়নি সেগুলিও। যেখানকার জিনিস সেখানেই রয়ে আছে। অগত্যা পুলিশ একবার নেড়েচেড়ে দেখে সেগুলো যথাস্থানে রেখে চলে গেল। কিন্তু এই রহস্যের সমাধান আর কিছুতেই হয় না। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, মাথার পিছনে ভারী কিছুর আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে লেরুর। কিন্তু এমন কোনও মোটিফ বা ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না, যার সূত্র ধরে আততায়ীর সন্ধান করা যায়।
আরও শুনুন: পুলিশের ঘুম ছুটিয়েছিল কলকাতার প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার
শেষমেশ রহস্য উদঘাটনের ভার পড়ল গোয়েন্দা দপ্তরের উপর। দপ্তরের এক ঝানু গোয়েন্দা গেলেন অকুস্থল পরিদর্শনে। ততদিনে অধিকাংশ সারকামস্টেন্সিয়াল এভিডেন্স-ই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। গোয়েন্দা ঘুরে ঘুরে দেখছেন ঘরখানা। আচমকা মনে পড়ল, পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ডেস্কের একটা ড্রয়ার আধখোলা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। অন্ধকারের মাঝে ওই একটি সূত্র পেয়ে, সেটিকেই তিনি খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরলেন। আর তখনই হাতে পেলেন লেরুর ডাকটিকিটের অ্যালবাম। সাত পাঁচ না ভেবে উলটে পালটে দেখতে লাগলেন অ্যালবামের পাতা। যত দেখেন তত অবাক হন গোয়েন্দা। নিহত ব্যক্তি শুধু ডাকটকিটের দারুণ একজন সংগ্রাহক ছিলেন বললে ভুল হবে, এ ব্যাপারে তিনি খুব গোছানো মানুষও ছিলেন। গোড়ায় সূচিপত্র করে, প্রত্যেকটা ডাকটিকিট এবং তার সংগ্রহের ইতিবৃত্ত সুন্দর করে লিখে রেখে গিয়েছেন। মানুষটা আর নেই। তবু তাঁর কাজের নমুনা রয়ে গিয়েছে। অ্যালবামটি উলটে উলটে দেখতে দেখতে এসব কথাই ভাবছিলেন গোয়েন্দা। আচমকা থমকে গেলেন একটা জায়গায়। বারকয়েক মিলিয়ে দেখলেন ভালো করে। হ্যাঁ, অ্যালবামের একটা পাতায় একটা ডাকটিকিটের বিবরণ লেখা আছে। কিন্তু টিকিটটাই যে নেই! লেরু কি তা বিক্রি করেছিলেন কাউকে? গেল কোথায় টিকিট? এই হারানো ডাকটকিট কি কি খুনের একটা সূত্র? নিজে এ কথা ভেবেই নিজেই হকচকিয়ে গেলেন গোয়েন্দা। একটা ডাকটিকিটের জন্য কেউ খুন হয়েছেন? এ কথা কেই-বা বিশ্বাস করবে? সেদিনের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখলেন, ওই টিকিটের দাম হাজার কয়েক টাকা হবে, যার জন্য কেউ কাউকে খুন করতে পারে না। তাহলে? কেন খুন হলেন গ্যাস্টন লেরু? রহস্য যেন কাটতেই চায় না।
গোয়েন্দা যত ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন, তাঁর ভাবনায় তত ফিরে ফিরে এল ওই ডাকটিকিট-ই। স্থির করলেন, এই ধরেই অনুসন্ধান চালাবেন। তারপর যা হবে দেখা যাবে। নিজে ডাকটিকিট নিয়ে এবার পড়াশোনা শুরু করলেন। আর তখনই বুঝতে পারলেন, এই খোয়া যাওয়া টিকিট-টি হল ‘হাওয়াইয়ান মিশনারিজ’। ২ সেন্টের একটা টিকিট। ‘হাওয়াইয়ান মিশনারিজ’ টিকিট এমনিতে বেশ দুর্লভ। তার মধ্যে এই ২ সেন্টের টিকিট তো আর পাওয়াই যায় না প্রায়। তাহলে কি এই দুষ্প্রাপ্য টিকিটের লোভেই কেউ লেরুকে খুন করল! বিদ্যুৎ খেলে গেল গোয়েন্দার মাথায়। এবার তিনি ডাকটিকিট সংগ্রাহকদের মেলামেশা করতে শুরু করলেন। সূত্র ধরে একটু এগোতেই সন্ধান পেলেন হেক্টর গিরু নামে এক ভদ্রলোকের। তাঁর সঙ্গে নাকি নিহতের একটি ডাকটিকিট কেনাবেচার কথা হচ্ছিল বলেও খবর কানে এল গোয়েন্দার। ঝানু গোয়েন্দা এরপর আর দেরি করলেন না। ছুতোনাতায় হেক্টরের সঙ্গে দেখা করে রীতিমতো ভাব জমিয়ে ফেললেন তিনি। যা পড়াশোনা করেছিলেন, তা খাটিয়ে নিজেকে ডাকটিকিটের একজন সমঝদার হিসাবেই পরিচয় দিলেন হেক্টরের কাছে। আর এটা সেটায় একদিন হেক্টরের বাড়িতে টিকিট দেখার আমন্ত্রণও পেয়ে গেলেন। হেক্টর তো নয়া বন্ধুকে পেয়ে খুশিতে ডগমগ। নতুন বন্ধুকে মনের আনন্দে দেখাতে লাগলেন টিকিটের সংগ্রহ। এই নিয়ে নানা গল্প যখন বলছেন হেক্টর, গোয়েন্দা তখন চাললেন তাঁর চাল। বললেন, হাওয়াইয়ান মিশনারিজ ডাকটিকিট না-দেখার দুঃখ তাঁর গেল না। হেক্টর বললেন, এ আর এমন বড় ব্যাপার কী! বলে তাঁর সংগ্রহ থেকে দেখাতে লাগলেন এই ধরনের টিকিট। শুধু ওই ২ সেন্টের টিকিটের কাছে এসে তাড়াহুড়োয় অ্যালবামের পাতা উলটে দিলেন হেক্টর। শুধু বললেন, এটি তিনি সদ্যই সংগ্রহ করেছেন।
গোয়েন্দার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল। ২ সেন্টের টিকিট আঁকড়েই দু’য়ে দু’ইয়ে চার করলেন তিনি। আর পরদিন সকালে হেক্টরের ঘুম ভাঙল পুলিশের হাঁকডাকে। হেক্টর চমকে দেখলেন, পুলিশের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর নতুন বন্ধু। বন্ধুর এই নতুন রূপ দেখে তিনি তো তখন হতচকিত। এবার আর কোনও ঘুরপাকের কথা নয়, গোয়েন্দার সোজা প্রশ্ন ভেসে এল, ২ সেন্টের ডাকটিকিটটা কোথা থেকে পেয়েছেন? এর উত্তর আর কিছুতেই দিতে পারেন না হেক্টর। শেষমেশ আদালতের সামনে খোলসা হল সমস্ত কথা। হ্যাঁ, ওই একটা টিকিটের জন্যই খুন হতে হয়েছিল লেরুকে। জানা গেল, লেরু কিছুতেই ওই টিকিট হেক্টরকে বিক্রি করতে চাইছিলেন না। এদিকে ওই টিকিটখানা না পেলে হেক্টরে কালেকশন সম্পূর্ণ হচ্ছে না কিছুতেই। রাগে তখন হেক্টরের মাথায় আগুন জ্বলছে। ভারী পেপারওয়েটটা তুলে সজোরে মেরেছিলেন লেরুর মাথায়। … বাকি ঘটনা তো সকলেরই জানা।
নেহাত সন্দেহের বশেই গেস্টন লেরুর হত্যাকারীকে পাকড়াও করেছিলেন গোয়েন্দা। বাস্তবে দেখা গেল তাঁর অনুমান অভ্রান্ত। আর এই রহস্য সমাধানের নেপথ্যে থেকে গেল একটি ২ সেন্টের ডাকটিকিট। আর কোনও ক্লু ছিল না। জীবনভর যে-ডাকটিকিটকে ভালোবেসেছিলেন লেরু, তাঁর আততায়ীকে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই ডাকটিকিটই।