সম্প্রতি মন্দির বনাম মসজিদ নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। এদিকে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বাপু অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধীর স্বপ্নের ভারতবর্ষ গড়ে তুলতেই তিনি সচেষ্ট। এই অবকাশেই একবার ফিরে দেখা যাক, মন্দির-মসজিদ নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ প্রসঙ্গে কী মতামত ছিল স্বয়ং গান্ধীর?
‘এ-দেশের জনমতকে এমনভাবে গঠন করিতে হইবে- যেন কাহারও ধর্মকে আক্রমণ করিবার প্রবৃত্তি কাহারও মনে না জাগে” – এই বিশ্বাস ছিল মহাত্মা গান্ধীর। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে তিনি আজীবন ভেবেছেন। যদিও জীবদ্দশায় তাঁকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা দেখেও যেতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও দুই সম্প্রদায়ের সমন্বয় ভাবনার পথ তিনি কখনও পরিত্যাগ করেননি। বরং, যদি তাঁকে বলা হত যে দুই সম্প্রদায়ের ‘সহজাত শত্রুতা’ আছে, তবে তিনি আপত্তি জানাতেন। তাঁর মতে, কিছু ভেদাভদের নমুনা আছে বলেই একে সহজাত শত্রুতা বলা যায় না।
আরও শুনুন: হজে যাওয়া নয়, ঘরহারা মানুষের আশ্রয়েই পুণ্য… সরকারকে জমি দান করে নজির দম্পতির
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে গান্ধীর যে মতামত ছিল, তা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেনি। দুই সম্প্রদায় অনেক সময়ই তাঁকে নিজেদের বিরোধী ভেবেছে। কিন্তু বাস্তবিক তা নয়। মানবতার পূজারী গান্ধী সম্প্রদায়গত ভেদের ঊর্ধে ওঠার কথাই আজীবন বলেছেন। আর তাই তাঁর কথাতে এসেছে দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই ত্রুটি নিয়ে আলোচনা। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সম্প্রীতি-ভাবুক রেজাউল করীম এ নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। গান্ধীর আদর্শের সারসত্যটুকু তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। যদিও এই মানবতার বাণী যে সবসময় মানুষ মনে রেখেছেন, তা নয়। ফলত ভেদাভেদ মাথাচাড়া দিয়েছে বিভিন্ন সময়। আর তা নিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন গান্ধী। ১৯২৪ সালে ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় এই সম্পর্কে তিনি যা জানিয়েছিলেন, রেজাউল করীম তা অনুবাদ করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। গান্ধী বলেছিলেন, “এমনকী যদি বহু মন্দির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, তবুও আমি মসজিদ স্পর্শ করিব না। এবং এইভাবে আমি তথাকথিত ধর্মান্ধ ব্যক্তির সম্মুখে আমার ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করিব। … নিজের ধর্ম ও মন্দির রক্ষার জন্য হিন্দু যেন অপরের মসজিদ ধ্বংস না করে, বা অপরের প্রাণনাশ না করে। মন্দির ও দেবতাকে রক্ষার কাজে রত থাকা অবস্থায় কেমন করিয়া মৃত্যুবরণ করিতে হয়, তাহা সে শিখুক। কিন্তু হিন্দু তাহাদের ধর্ম অথবা মন্দির রক্ষা করিতে অপারগ হইয়া যদি মসজিদ ধ্বংস করে, তাহা হইলে সে ইহাই প্রমাণ করবে যে, মন্দিরধ্বংসকারী মুসলমানের মতোই সেও ধর্মান্ধ।”
আরও শুনুন: কুতুব মিনার কি আদৌ দিল্লিতে ছিল! বিষ্ণুর সঙ্গেই বা কী যোগ এই স্তম্ভের?
শুধু হিন্দুদের উদ্দেশে এ কথা বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি। মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “হিন্দুরা যদি উন্মত্ত হইয়া মসজিদ ধ্বংস করে- তাহা হইলে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করিতেই হইবে, ইহা কোন ধরনের কথা? ইহাও সেই প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসার কথা।” তিনি জানিয়েছিলেন, মুসলমানের আচরণই তাঁর ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে, অন্য কিছু নয়।
অর্থাৎ, দুই সম্প্রদায়কেই গান্ধী বোঝাতে চেয়েছিলেন, ধর্মান্ধতা কোনও সমাধান হতে পারে না। বরং ধর্মান্ধতা ত্যাগ করাই উচিত। আর সে কাজে এগিয়ে আসতে হবে দুই সম্প্রদায়ের মানুষকেই। আজকের ভারতবর্ষে গান্ধীর এই বাণী বা মতামত যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথ্যসূত্র: সাম্প্রদায়িক সমস্যা ও গান্ধীজি / রেজাউল করীম (সূত্রধর)