এক শীতের রাত। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গাঢ় হয়েছে। ধুনি জ্বেলে, আগুনের চারপাশে ধ্যানে মগ্ন নয় যুবক। ধ্যান শেষ হতেই শুরু হল আলোচনা, যিশুর জীবনকাহিনি শোনালেন দলপতি, নরেন্দ্রনাথ। পরহিতে কাজের সংকল্প নেওয়া হল। জগতের কল্যাণকল্পে সংসার ত্যাগের পথে এগোলেন শরৎ, শশী, বাবুরামরা। ধুনির আগুন হয়ে উঠল ত্যাগের প্রতীক। রোপিত হল সংঘের বীজ। দিনটা ছিল ১৮৮৬-র ২৪ ডিসেম্বর। লিখছেন সৌভিক রায়।
খ্রিস্ট আর রামকৃষ্টে (পড়ুন রামকৃষ্ণে) কি আদৌ কোনও তফাৎ আছে? প্রতি সন্ধ্যায় বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মন্দিরে যখন আরাত্রিক ভজনের সুর ওঠে, তাতে যেন মিশে থাকে গির্জার প্রার্থনা সঙ্গীতের মূর্ছনা। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীতে সর্বধর্মসমন্বয়ের ছাপ আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘খণ্ডন-ভব-বন্ধন জগবন্দন বন্দি তোমায়’ উচ্চারণ মনে করিয়ে দেয়, প্রভু যিশুও তো সমস্ত বন্ধনের বাঁধন পেরোতে পেরেছিলেন। তাঁর প্রাণও আর্ত মানুষের জন্য কাঁদত। তিনিও জীব সেবার কথা বলে গিয়েছেন।
২৪ ডিসেম্বর, ক্রিসমাস ইভ। মহামানবের জন্মের আগের রাত। ফি বছর এদিন সন্ধ্যায়, সন্ধ্যা-আরতির পর বেলুড় মঠে যিশুর আরাধনা হয়। ফুল আর আলোয় মালায় সাজিয়ে তোলা হয় প্রভু যিশুর ছবি। কেক, বিস্কুট, পেস্ট্রি, লজেন্স, চকোলেট নিবেদন করা হয়। চলে বাইবেল পাঠ। গাওয়া হয় ক্রিসমাস ক্যারল। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যান্য শাখাতেও এদিনটিতে ‘যিশু পুজোর’ আয়োজন করা হয়।
রামকৃষ্ণ সংঘে কীভাবে শুরু হল প্রভু যিশুর আরাধনা?
উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হয় উনিশ শতকে। তখন তরুণ-শিক্ষিত হিন্দু সমাজ ক্রমেই খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল। তবে সে’সময় উল্টো স্রোত দুই শিবিরে, একদিকে দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসদেব আর অন্য শিবিরটি কেশব সেনের ব্রাহ্ম সমাজ। রামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে একটু একটু করে চলছিল সংঘ নির্মাণের প্রস্তুতি। তাঁর রোগভোগ-কে কেন্দ্র করে দানা বাঁধার পথে এগোয় সংঘ। সে সংঘ পুরোদস্তুর জমাট বাঁধল ক্রিসমাস ইভে, আঁটপুরে। এই আঁটপুরের প্রাচীন রাধাগোবিন্দ মন্দির সর্বধর্মসমন্বয়ের সাক্ষী বহন করে। ১৭৮৬ সালে কৃষ্ণরাম মিত্রর গড়া, এ মন্দিরে মিশরের ফ্যারাও থেকে মেরি-যিশু, সব্বাই আছেন। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতাকে উপজীব্য করে তৈরি সংঘের জন্ম হচ্ছে বহুধর্মের মিলনক্ষেত্র আঁটপুরে, কী অদ্ভুত সমাপতন!
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর, ১৮৮৬-র ডিসেম্বরে হুগলির আঁটপুরে স্বামী প্রেমানন্দের বাড়িতে গেলেন গুরুভাইরা (নরেন্দ্রনাথ, শরৎ, শশী, বাবুরাম, তারক, কালী, নিরঞ্জন, গঙ্গাধর, সারদা)। প্রেমানন্দের মা-ই তাঁদের ডেকেছিলেন। তবে তখনও তিনি বাবুরাম। সিমলেপাড়ার নরেন দত্ত’ও তখন বিবেকানন্দ হননি। প্রেমানন্দের বাড়িতেই স্বামীজি ও তাঁর আট গুরুভাই শপথ নেন তাঁরা রামকৃষ্ণের ‘জীব সেবা’র আদর্শে জীবন অতিবাহিত করবেন।
এক শীতের রাত। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গাঢ় হয়েছে। ধুনি জ্বেলে, আগুনের চারপাশে ধ্যানে মগ্ন নয় যুবক। ধ্যান শেষ হতেই শুরু হল আলোচনা, যিশুর জীবনকাহিনি শোনালেন দলপতি, নরেন্দ্রনাথ। পরহিতে কাজের সংকল্প নেওয়া হল। জগতের কল্যাণকল্পে সংসার ত্যাগের পথে এগোলেন শরৎ, শশী, বাবুরামরা। ধুনির আগুন হয়ে উঠল ত্যাগের প্রতীক। রোপিত হল সংঘের বীজ। দিনটা ছিল ১৮৮৬-র ২৪ ডিসেম্বর। একদিন কাশিপুরে বসে যে কাঠামোয় রামকৃষ্ণ খড় বেঁধেছিলেন, তাতে মাটি পড়ল। রং ও অঙ্গরাগ হল পরের বছর, ১৮৯৭-তে।
এই ঘটনাকে স্মরণে রেখে অদ্যাবধি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে ক্রিসমাস ইভে যিশুপুজোর আয়োজন করা হয়।
কিন্তু যাঁর নামে সংঘ, তাঁর জীবনে কীভাবে এসেছিলেন যিশু?
যত মত তত পথের দিশারী রামকৃষ্ণ সম্পর্কে প্রবাসী পাত্রিকায় রবি ঠাকুর লিখেছিলেন,
“বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা
ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা।”
প্রকৃত অর্থেই বহু সাধকের বহু সাধনা এসে মিলিত হয়েছিল পরমহংস নামের মহাসাগরে।
রামকৃষ্ণ একাধিক ধর্মের পথ অবলম্বন করেছিলেন, বলা ভালো অনুশীলন করেছিলেন। তার মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মও ছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, “যাঁকে কৃষ্ণ বলা হয়, তিনিই শিব এবং তিনিই আদ্যাশক্তি, যীশু ও আল্লাহ্ নামে পরিচিত – এক রাম, তাঁর হাজার নাম।”
যদু মল্লিকের বাগানবাড়ির বৈঠকখানায় যিশুর ছবি দেখে ভাবসমাধিস্থ হয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর। তাঁর ভক্ত শম্ভুচরণ মল্লিক তাঁকে বাইবেলের কাহিনি শোনাতেন। যিশুর প্রভাব এক সময় এতটাই পড়েছিল যে, কালীঘরে যাওয়া ক’দিনের জন্য বন্ধ রেখেছিলেন পরমহংস। বলতেন, তাঁর সঙ্গে যিশুর সাক্ষাৎও হয়েছে। ভক্তদের মধ্যে কেউ যদি বলতেন ‘আপনার সঙ্গে যিশুর মিল রয়েছে’, তাহলে শিশুর মতো আল্লাদে আটখানা হয়ে শুনতে চাইতেন ‘কী কী মিল আছে?’ দক্ষিণেশ্বরে নিজের ঘরে যিশুর ছবি রেখেছিলেন, তাতে সকাল-সন্ধ্যে ধূপধুনো পড়ত। এখনও তাই ক্রিসমাস ইভের রাতে যিশুর আরাধনায় শামিল হয় মঠ।
==০==