ডাইনি মেডুসার চোখের দিকে তাকালেই পাথর হয়ে যেত যে কোনও জীবন্ত প্রাণী। তেমনই ভয়ংকর ক্ষমতা রাখে এই হ্রদের জলও। তার ছোঁয়ায় পাথরে পরিণত হয় প্রাণীরা। এমনই জনশ্রুতি প্রচলিত এই হ্রদ সম্পর্কে। নিছক গুজব নয়, রয়েছে পাথুরে প্রমাণও। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
এ যেন এক অভিশপ্ত জায়গা। বাতাস এখানে থমথমে হয়ে থাকে। নড়ে না গাছের পাতাও। প্রাণীরাও এড়িয়ে চলতে চায় এই মারণভূমিকে। মারণভূমিই তো। যা অনায়াসে প্রাণের স্পন্দন কেড়ে নিতে পারে কোনও জীবিত দেহ থেকে, তাকে আর কী বলা যায়! না, নিছক কল্পকাহিনি নয়। নয় মেডুসার গল্পের মতো কোনও পুরাণের আখ্যান। বাস্তব পৃথিবীতেই হদিশ মেলে এই অভিশপ্ত জগতের। যেখানে প্রাণ নেই। রয়েছে কেবল একাধিক প্রাণীর পাথর হয়ে যাওয়া প্রাণহীন দেহ।
আরও শুনুন: ৪০০ বছর ধরে সমুদ্রে ঘুরে চলেছে ভূতুড়ে জাহাজ! কী এই রহস্য?
আদতে এটি একটি হ্রদ। আপাদমস্তক রহস্যের কুয়াশায় মোড়া। প্রাণীদের পাথরে পরিণত হওয়ার রটনা বয়ে নিয়েই প্রথম প্রকাশ্যে এসেছে আফ্রিকা মহাদেশের তানজানিয়াতে অবস্থিত এই লেকের খবর।
২০১১ সালে পূর্ব আফ্রিকার বিপন্ন জীব প্রজাতিগুলির খোঁজে এক অভিযানে পাড়ি দিয়েছিলেন ফটোগ্রাফার নিক ব্র্যান্ট। তিনিই প্রথম হ্রদটির এই আশ্চর্য বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পান। হ্রদের ধারে একাধিক প্রাণীর পাথর হয়ে যাওয়া দেহ দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। এমন হাড় হিম করা দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করতে অবশ্য তিনি ভোলেননি। দেহগুলিকে অবিকৃত রেখে এমনভাবে দৃশ্য সাজিয়ে নিয়েছেন তিনি, যেন তারা জীবিত। তাঁর ছবিতে কোথাও গাছের ডালে বসে বসেই ঝলসে গিয়েছে বাদুড়। জলের উপর জেগে থাকা পাথরে বসে নিজেও পাথর হয়ে গিয়েছে চড়ুই পাখি। কোথাও আবার জলের উপরেই থমকে গিয়েছে জলচর পাখির সাঁতার। যেন মৃত প্রাণী নয়, এমনিই কোনও জাদুঘরে স্টাফ করে রাখা দেহ। এই সজ্জার কারণেই আরও বীভৎস হয়ে উঠেছে এই মৃত্যুসংবাদ। ২০১৩ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের এক প্রদর্শনীতে তাঁর তোলা ছবিগুলি দেখে শিউরে ওঠে সারা দুনিয়া।
আরও শুনুন: রহস্যভেদে তুখোড় কোন প্রজাতির কুকুরেরা! জেনে নিন
কিন্তু কী এমন রয়েছে লেক নেট্রন নামের ওই হ্রদে, যার ফলে এমনভাবে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে প্রাণীরা? সত্যিই কি এই হ্রদের জল ছুঁলেই পাথর হয়ে যেতে হয়? বিজ্ঞানীরা অবশ্য কোনও অভিশাপের তত্ত্ব মানতে নারাজ। প্রাণীগুলির এভাবে পাথর হয়ে যাওয়ার পিছনে বৈজ্ঞানিক কারণই খুঁজেছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, আসলে তানজানিয়ার এই হ্রদটি লবণহ্রদ, যেখানে বাষ্পীভূত হওয়া ছাড়া জলের বেরোনোর কোনও রাস্তা নেই। আর এই বাষ্পীভবনের সময় ছড়িয়ে পড়ে লবণ এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থও। তার উপর এই হ্রদের জলে নেট্রন, অর্থাৎ সোডিয়াম কার্বনেট ও বেকিং সোডা থাকার দরুন তা অতি মাত্রায় ক্ষারক। আর সেই কারণেই তা যে কোনও কিছুকে অতি মাত্রায় ক্ষয় করে দিতে পারে, যেমনটা ঘটেছিল একটি হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রে। রাসায়নিক পদার্থগুলির উপস্থিতির কারণে এই হ্রদকে উঁচু থেকে কাচ বলে ভ্রম হয়। সেই কারণে হ্রদের জলে পড়ে প্রায়শই প্রাণ হারায় পরিযায়ী পাখিরা। একই ঘটনা ঘটেছিল ওই হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রেও। আর এমন ঘটনার দৌলতেই লেক নেট্রন ঘিরে আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে রহস্যের চাদর।