পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন আসলে মানুষের অস্তিত্বরক্ষারই আন্দোলন। এ আর শুধু তাত্ত্বিক কথা নয়। দূষণের মূল কারণ অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা। অর্থাৎ ভূত আসলে সর্ষের মধ্যেই। আর সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন সাধারণ মানুষ।
আকাশে কালো ধোঁয়া। বাতাসে ধুলো। দূষণের বিষাক্ত চাদর যেন ঘিরে আছে গোটা শহরটাকেই। শ্বাস নিয়ে বাঁচাও যেন দুষ্কর হয়ে উঠেছে বাসিন্দাদের কাছে। দেখে মনে হতে পারে, এ যেন ‘কল্কি’ সিনেমার দৃশ্য। তবে, এমনই এক শহর আছে বাস্তবের পৃথিবীতেও। দিল্লি ও কলকাতার মতো মেট্রোসিটিকেও দূষণে হার মানাল যে শহর। একবার নয়, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেশের সবচেয়ে দূষিত শহরের তকমা লাগলো এই শহরের গায়ে।
আরও শুনুন: দূষণের দিল্লিতে ‘অভয়ারণ্য’! AQI মোটে ১৫, বাঁচার মডেল যেন দম্পতির ‘সবুজ বাড়ি’
অসম ও মেঘালয়ের সীমান্তের কাছাকাছি ছোট্টো একটি শহর বর্নিহাট (Byrnihat)। ঘটনাচক্রে দেশের সবথেকে দূষিত শহর এটিই। এমন নয় যে, আগে সেখানে পরিবেশ বেশ মনোরম ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তা চূড়ান্ত দূষিত হয়েছে। দূষণ-দানব আগেও এই শহরকে কবজা করেছে। বাসিন্দারা তাঁদের ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন। কিন্তু সুরাহা কিছু হয়নি। ফলত দ্বিতীয়বার আবার দূষিত শহর হয়েছে এই বর্নিহাট। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে কোনও উন্নতি নেই, ‘ভেরি পুয়োর’ গুণমান নিয়েই চলছেন বাসিন্দারা। বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটারের উপস্থিতি সাংঘাতিক পরিমাণে (PM2.5 and PM10)। এই দুরবস্থা মূলত ঘনিয়ে উঠেছে যথেচ্ছ শিল্পায়নের কারণেই। এই অঞ্চলে নয় নয় করে প্রায় ৪১টি কারখানা। আছে স্টিল, সিমেন্টের মতো ভারী শিল্পও। এই সমস্ত কারখানার দূষণই মূলত এই অঞ্চলের পরিবেশকে মারাত্মক দূষিত করে তুলেছে। একই রকম দূষণের গ্রাসে পড়েছে বিহারের সমস্তিপুর। মূলত দুটি শহরই দূষণের নিরিখে সংকটের জায়গায় আছে। সেই সংকটের কথা বারেবারেই বলেছেন বর্নিহাটের বাসিন্দারা। তাঁদের আক্ষেপ, বাচ্চারা স্কুলে পর্যন্ত গিয়ে বসতে পারে না, কেননা ধুলোয় চারিদিক আচ্ছন্ন। বাড়ি ফিরে স্নান করলে কালো জল গড়িয়ে পড়ে শরীর থেকে। স্বাভাবিক ভাবেই, এই অঞ্চলে সবুজের দেখা নেই। গাছের পাতা দূষণে বাদামি হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্যের সমস্যা, বিশেষত শ্বাসকষ্টজনিত অসুখে ভুগতে শুরু করেছেন বাসিন্দারা।
আরও শুনুন: সমুদ্র ভরেছে প্লাস্টিক বর্জ্যে, মিটিংয়েই ব্যস্ত নেতারা! দূষণকে নেল-আর্টে বদলে বার্তা শিল্পীর
তবু, সমাধান কই! দূষিত শহরের তকমা তো আর গর্ব করে বলার মতো কিছু নয়। আর তাই বাসিন্দারা একজোট হয়ে পথে নেমেছেন। পরিবেশ ধ্বংস করে যেভাবে কারখানা চলছে, তাতে যে তাঁদের অস্তিত্বেরই সংকট দিনে দিনে বাড়ছে, সেই কথাটাই দেশের সামনে তুলে ধরতে চান তাঁরা। তাঁদের অভিযোগ, কারখানা থাকায় তাঁদের আপত্তি নেই। কিন্তু কারখানা যেভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে, যেভাবে ফিল্টার না করেই বর্জ্য গ্যাস ইত্যাদি বাতাসে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। দূষণ নিয়ন্ত্রণ এখানে শুধু নামে আছে, আদতে কাজের কাজ কিছু নেই, এমনটাই তাঁদের অভিযোগ। আর তাই দেওয়ালে পিঠ থেকে গেছে বলেই, এবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন তাঁরা। সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করছেন, যাতে অন্তত বাঁচার অক্সিজেনটুকু তাঁরা পেতে পারেন।
পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন আসলে মানুষের অস্তিত্বরক্ষারই আন্দোলন। এ আর শুধু তাত্ত্বিক কথা নয়। দূষণের মূল কারণ অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা। অর্থাৎ ভূত আসলে সর্ষের মধ্যেই। আর সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন সাধারণ মানুষ। ছোট্ট শহর বর্নিহাটের এই প্রতিরোধ তাই যেন সামগ্রিক পরিবেশ-রক্ষা আন্দোলনকেই পথ দেখাচ্ছে নতুন করে।