এ দেশ দস্যুর কবি হয়ে ওঠার গল্পও জানে। জানে, অস্ত্র নয়, মানুষকে বদলে দেওয়ার জোর লুকিয়ে থাকে অক্ষরের মধ্যেই। সে অক্ষরে হাত ডুবিয়েই জীবন কাটান যিনি, মানুষের কাছের জন হয়ে ওঠাই তাঁর ধর্ম। সাধু হোক কি চোর, যে কেউ সহজেই হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন কবির দিকেই।
এ পৃথিবীতে দুরকম মানুষকে নিশাচর তকমা দেওয়া সাজে। রাতেই নাকি তাঁদের হাত খোলে। এক পক্ষের হাত চলে সাফাইয়ে। অন্য পক্ষের হাতের খেলা অবশ্য স্রেফ খাতার পাতায়। এই হাতে হাতে যোগাযোগ সবসময় সামনে আসে না হয়তো। তবে গল্পগুজবে কিন্তু তার কথা উঠেই আসে। এতক্ষণে হয়তো বুঝেই গিয়েছেন, এই দু পক্ষের একদিকে দাঁড়িয়ে কবি, আর অন্যদিকে দাঁড়িয়ে চোর। নিছক মজার ছলেই এমন মিলের কথা বলা হয় অবশ্য। নইলে সামাজিক হিসেবে দুজনের মধ্যে তো বিস্তর ব্যবধান। তবে, এ কথাও ঠিক, সেই ব্যবধানকে পাত্তাও না দিতে পারেন একজন কবিই। রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান। রাজার চেয়েও, কবির ক্ষেত্রেই হয়তো এ কথা আরও বেশি করে খাটে। কারণ কবির চোখে তো ভেদ থাকে না। মানুষের মাঝে ভেদাভেদ করা কবির ধর্ম নয়। আর সেই কারণেই সব মানুষের কাছের জন হতে পারেন তিনিই। সাধু হোক কি চোর, যে কেউ সহজেই হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন কবির দিকেই।
আরও শুনুন:
ব্রেন গিয়েছে চুরি, তাও আবার আইনস্টাইনের! কে সেই কুখ্যাত চোর?
কিন্তু হঠাৎ কবির কথা উঠছে কেন? উঠছে যে, তার নেপথ্যে আসলে রয়েছে এক চোরই। যে চুরি করতে ঢুকে পড়েছিল এক কবির ঘরে। ঘরে কেউ ছিল না, বাধা ছিল না চুরিতেও। হাতে এসেছিল একটি এলইডি টিভি সহ আরও নানা দামি দামি জিনিসপত্রও। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে, আসলে সে বাড়ি এক বিখ্যাত কবির, সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় চোরাই মাল সে রেখে দেয় জায়গামতোই। ভাবছেন, এমনটা যে ঘটেছে, তাই বা জানা গেল কেমন করে! তার কারণ, জিনিসপত্রের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে একটি চিঠিও লিখে রেখে গিয়েছে চোর নিজেই।
কী ভাবছেন, নিছকই আজগুবি গল্প? দাঁড়ান, তাহলে একটু খুলেই বলা যাক।
আসলে, মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত কবি নারায়ণ সারভে। অনাথ নারায়ণের প্রথম জীবনটা কেটেছে অতীব কষ্টে। পথে পথে জীবন কাটিয়েছেন, লোকের দুয়ারে কাজ করে পেট চালাতে হয়েছে। পোষ্য কুকুরের দেখাশোনা করে খাবার জুটিয়েছেন কখনও বা। আর এই গোটা সময়টা জুড়ে দেখেছেন তাঁর আশপাশকে। না-পাওয়া মানুষের জীবন, খেটে খাওয়া মানুষের জীবন, দেখতে দেখতে লিখতে শুরু করেছিলেন নারায়ণ। আজীবন তাই লিখে গিয়েছেন। সেই লেখাই কবি হিসেবে তাঁকে চিনিয়েছে সাহিত্যের দুনিয়ায়। এসেছে দুহাত ভরা সম্মান। ২০১০ সালে তাঁর প্রয়াণের পর, তাঁর বাড়িতে এখন থাকেন সারভে-কন্যা সুজাতা ও তাঁর স্বামী গণেশ। সম্প্রতি ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন দম্পতি। ১০ দিন ধরে গোটা বাড়ি ফাঁকা। সেই সুযোগেই একদিন রাতে বাড়িতে ঢুকেছিল চোর। প্রথম অভিযানে সফলভাবে এলইডি টিভি-সহ বেশ কিছু সামগ্রী হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেয় সে। তারপর মনে হয়, আরও একবার অভিযানে নামলেই বা মন্দ কী! কিন্তু এবার বাড়িতে ঢুকে এদিকে ওদিকে ঘুরতে ঘুরতে তার চোখে পড়ে যায় প্রয়াত কবি সারভের ছবি ও কিছু স্মারক। তা দেখেই ওই চোর বুঝতে পারে, সে কোথায় চুরি করতে ঢুকেছে। না, শুধু ছবি দেখেই নয়, আসলে সারভের অনেক কবিতাই তার পড়া। এরপরেই অপরাধবোধে আগের চুরি করা সবকিছু ফিরিয়ে দিয়ে প্রয়াত কবির কাছে ক্ষমা চেয়ে যায় সে।
আরও শুনুন:
চোর বাবাজির বোধোদয়! মন্দিরে চুরির ৯ বছর পরে কৃষ্ণের গয়না ফেরত, সঙ্গে জরিমানাও
এ দেশ অবশ্য দস্যুর কবি হয়ে ওঠার গল্পও জানে। জানে, অস্ত্র নয়, মানুষকে বদলে দেওয়ার জোর লুকিয়ে থাকে অক্ষরের মধ্যেই। সে অক্ষরে হাত ডুবিয়েই জীবন কাটান যিনি, মানুষের কাছের জন হয়ে ওঠাই তাঁর ধর্ম। ধনদৌলতের প্রাচুর্য না হোক, সেই ভালোবাসাই তাঁর অর্জন। সারভে তাঁর গোটা জীবনে বহু সম্মান পেয়েছেন। তবুও, অক্ষরের টানেই অন্ধকারে তলিয়ে থাকা এক সাধারণ মানুষকেও যে তিনি কাছে টানতে পারলেন, এও বুঝি তাঁর আরেক সম্মান, কিংবা আরও একটি কবিতা।
[ছবি: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়]