কালী যতটা রামপ্রসাদের। ততটাই নজরুলের। ধর্মের গণ্ডি টেনে, এই দেবীকে অন্তত ভাগ করা যায় না। আর সেই প্রমাণ আরও স্পষ্ট হয় ত্রিপুরার এক কালীমন্দিরে। শোনা যায়, এই মন্দির তৈরি হয়েছিল জনৈক মুসলিম সেনার অনুরোধে। কেমন সেই কাহিনি? আসুন শুনে নিই।
আমাদের দেশে কালী আরাধনার চল আজকের নয়। রাজ-রাজাদের যুগেও কালীপুজোর ধুম ছিল চোখে পড়ার মতো। একে একে বর্গি, মোগল, শক, পাঠান, ব্রিটিশ কতই না উপজাতি এসেছে ভারত শাসন করতে, কালী পুজো বন্ধ করতে পারেনি কেউই। বলা ভালো, করতে চায়ওনি। বরং কালীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে কিছু ভিনধর্মীর নামও। তালিকায় ব্রিটিশ সাহেবের নামও রয়েছে।
আরও শুনুন: বিপ্লবী বাঘা যতীন থেকে রঘু ডাকাত, কীভাবে কালী হয়ে উঠলেন সকলের ‘মা’?
তবে এই মন্দিরের সঙ্গে সরাসরি যোগ রয়েছে এক মুসলিমের। তিনি অবশ্য নজরুলের মতো গীতিকার নন। একেবারে ময়দানে নেমে যুদ্ধ করা এক সেনা। তাঁর অনুরোধেই তৈরি হয়েছিল এক কালী মন্দির। সময়টা সাতের দশকের। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকটা বছর কেটেছে। বাংলাদেশ তখনও আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। এইসময় দেশের কিছু কিছু বর্ডার এলাকায় বছরভর অশান্তি লেগেই থাকত। কারণে অকারণে প্রতিবেশী দেশের থেকে উড়ে আসত গোলা-বারুদ। আচমকা হানায় মৃত্যু হত বহু সেনার। আবার পালটা জবাবও দিতে হত ভারতীয় সেনার তরফে। এইরকম পরিস্থিতি বেশ কিছুদিন চললে তা কার্যত যুদ্ধের আকার নিত। এই কালী মন্দির তৈরির নেপথ্যেও রয়েছে এমনই এক যুদ্ধের ঘটনা। শোনা যায়, ত্রিপুরার অঞ্চলের এক বর্ডারে হঠাৎ করেই একবার যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিনা নোটিশে সেই এলাকায় গোলা বর্ষণ শুরু করে পাকিস্তান। এদিকে বর্ডারের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনির কাছে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার মতো অস্ত্র ছিল না বললেই চলে। তাই শত্রুর হানায় অকালে প্রাণ হারাতে হয় অনেককেই। শেষমেশ বেঁচে যান তিনজন কনস্টেবল। কোনওক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে কিছু দূরে গা ঢাকা দেন তাঁরা। তিনজনেরই ধর্ম পরিচয় ছিল ভিন্ন। একজন নেপালি খ্রিষ্টান, একজন বাঙালি ব্রাহ্মণ আর একজন মুসলিম। তিনজনেই বুঝতে পারেন পালিয়ে বেশীক্ষণ বাঁচা যাবে না। যেভাবে গোলা বর্ষণ হচ্ছে, তাতে গোটা এলাকাই ধ্বংস হওয়ার উপক্রম। তাহলে উপায় কী?
আরও শুনুন: লক্ষ্মী বা সরস্বতীর মতো, কালীপুজোও কি বাড়িতেই করা যায়?
এমন সময় তাঁদের মধ্যে থাকা বাঙালি ব্রাহ্মণ বনবিহারী চক্রবর্তী মা কালীর নাম জপতে শুরু করেন। ইসলাম বা খ্রিষ্ট ধর্মে এই দেবীর কোনও উল্লেখ নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই, বাকী দুজন জানতে চান বনবিহারী কেন এই দেবীর নাম জপ করছেন। তখন কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, তাঁদেরও একই কাজ করতে বলেন বনবিহারী। সাত পাঁচ না ভেবে দুজনে তা করতেও শুরু করেন। শোনা যায়, দৈবের লীলায় ঠিক তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। একইসঙ্গে তাঁরা যে জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তার কাছেই একটা পুকুর আবিষ্কার করেন। বৃষ্টির মধ্যে গোলা বর্ষণ বিশেষ কাজ করবে না। আর পুকুরের জলে তো নয়ই। সে রাতটা ওইভাবেই জলের ধারে বসে কাটিয়ে দেন তিনজন। সকাল হতেই পরিবেশ শান্ত হয়। বনবিহারী কপালে হাত ঠেকিয়ে মা-কে প্রণাম জানান। আর বাকী দুজনও মনের অজান্তে সেই এক কাজ করে ফেলেন। সেই যাত্রায় বেঁচে যান তিনজনেই। পরে সেনার তরফে ওই এলাকায় একটি যুদ্ধস্মারক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই কাজ করতে বাধা দেন প্রাণ নিয়ে ফেরা সেই মুসলিম সেনাই। বরং সেখানে একটি কালী মন্দির গড়ার অনুরোধ জানান তিনি। সেনার ইতিহাসে এমনটা বিরল। কিন্তু সব ঘটনা শোনার পর তাঁর সেই অনুরোধ রাখা হয় সেনার তরফে। মন্দির তৈরিতে সাহায্য করেন স্থানীয়রাও। যেহেতু এই কালীর সঙ্গে যুদ্ধের যোগ সরাসরি, তাই মন্দিরের নাম রাখা হয় ‘রণ কালী’। ত্রিপুরার শ্রীনগর অঞ্চলে গেলে এখনও দেখা মেলে এই রণ কালীর মন্দির। যা মনে করিয়ে দেয়, ধর্ম যার যার, মা কালী সবার।