পুরুষ ও নারী দুয়ের সহাবস্থানেই এ সমাজের এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে যে একের প্রতি অপরের মনে এমন অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হল, তাকে নিছক অস্বীকার করে চললে তা কোনও দিনই মুছবে না। বরং সেই পরিস্থিতির শিকড়ে পৌঁছনোটাই জরুরি।
ধরা যাক গভীর জঙ্গলে আটকে পড়েছেন কোনও মহিলা। সেসময়ে তাঁর সঙ্গী রয়েছে কেবল একজনই। সেই সঙ্গী হিসাবে কাকে চান তিনি, একজন পুরুষ, নাকি একটি ভাল্লুক? গভীর জঙ্গলে একলা কার সঙ্গে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন তিনি? এমনই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল একাধিক মহিলার কাছে। এবং প্রশ্নকারীদের আশ্চর্য করে অধিকাংশ মহিলাই সেখানে ভোট দিয়েছেন ভাল্লুকের পক্ষে।
আরও শুনুন:
নারীর সম্মান তার যোনিতে রেখেছে কে! পালটা প্রশ্ন তুলেছিলেন কমলা ভাসিন
হ্যাঁ, পুরো প্রশ্নোত্তরের বিষয়টিই একটি কাল্পনিক পরিস্থিতি ভেবে তৈরি করা। কিন্তু সেই কাল্পনিক অবস্থাতেও যে মেয়েরা পুরুষের সাহচর্যকে কাঙ্ক্ষিত বলে মনে করতে পারছেন না, তা তো এড়িয়ে যাওয়ার নয়। দেখা যাচ্ছে, আটজন মহিলার মধ্যে সাতজনই চেয়েছেন, এহেন পরিস্থিতিতে কোনও পুরুষ নয়, বরং ভাল্লুকের মতো একটি বন্য জন্তুর সঙ্গে থাকলেই বেশি নিরাপদ বোধ করবেন তাঁরা। প্রথমেই একজন বলেছেন, পুরুষেরা ভীতিপ্রদ। আরেকজনের যুক্তি, যতদূর জানি, বিরক্ত না করলে ভাল্লুক তো তেড়ে এসে আক্রমণ করে না। কিন্তু পুরুষের থেকে যে বিনা প্ররোচনাতেও আক্রমণ আসতেই পারে, সেই আশঙ্কার কথাই ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। আরেক মহিলাই সে কথাই বলেছেন আরও একটু স্পষ্ট করে, কোনও ভাল্লুক কী করতে পারে সে কথা তো জানি। কিন্তু কোনও পুরুষ আকস্মিক পরিস্থিতির সুযোগ নেবেন কি না, তা তো জানি না। এমনকি যাঁরা আপাতদৃষ্টিতে বেশ সজ্জন, তাঁরাও যে ক্ষেত্রবিশেষে যৌন হেনস্তার মতো ঘটনা ঘটান, সে কথা তো সত্যিই আমাদের অজানা নয়। আবার এ কথাও আমরা জানি, যে, সেই হেনস্তার অভিযোগ প্রকাশ্যে এলে আরও অনেকগুলো অভিযোগের আঙুল উঠে আসে অভিযোগকারিণীর দিকেই। তার পোশাক, তার আচার আচরণ, সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন উঠতে থাকে। প্রশ্ন ওঠে সে কেন পুরুষটির সঙ্গে একা ছিল। অথচ পুরুষটি কেন একা পেয়ে এ কাজ করেছে, সে প্রশ্ন কোথায় তলিয়ে যায়। তাই একজন মহিলা বলছেন, অন্তত ভাল্লুকের হাতে আক্রান্ত হলে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। তাঁরা বলছেন, ভাল্লুক আক্রমণ করলে মানুষ অন্তত বিশ্বাস করবে। কেউ জিজ্ঞেস করবে না মেয়েটি ভাল্লুককে প্ররোচিত করেছিল কি না। কিংবা ধর্ষণ বা হেনস্তার পর যেমন মেয়েদের উদ্দেশে উপদেশের বন্যা বয়ে যায়, কী কী করা উচিত আর উচিত নয়, তা নিয়ে; ভাল্লুকের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য অন্তত তেমন কোনও টিপস আসবে না বলেই আশা করছেন মহিলারা।
হ্যাঁ, এ প্রশ্নোত্তরে অনেক পুরুষই অবশ্য খুশি হননি। যদিও মহিলারা কেন এ কথা বলছেন, তা গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখেননি প্রায় কেউই। একে স্রেফ পুরুষবিদ্বেষ বলেই দায় এড়িয়েছেন। বন্য জন্তুর হাত থেকে কী কী আক্রমণ আসতে পারে, তার দীর্ঘ তালিকাও দিতে ছাড়েননি। কিন্তু সেই আক্রমণের কথা কি মেয়েরা জানেন না? তারপরেও যে তাঁরা পুরুষের বদলে বন্য জন্তুকে বেছে নিলেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, তার পিছনে পুরুষের দীর্ঘ নির্যাতনের ইতিহাসটি না ভেবে দেখলে চলে কি? রাষ্ট্রসংঘের তথ্য জানায়, তিনজনের মধ্যে একজন মহিলা তাঁর সঙ্গী কিংবা অপরিচিত পুরুষের হাতে যৌন হেনস্তা বা হিংসার শিকার হন। গোটা পৃথিবীর নিরিখে সে সংখ্যাটা মোটামুটি সাড়ে ৭৩ কোটি। আর শুধু ২০২২ সালেই এইভাবে খুন হয়ে গিয়েছেন ৮৯ হাজার বালিকা ও নারী।
আরও শুনুন:
মেয়েদের দাম কত! শাসক থেকে বিরোধী, সব পথ শেষে মিলে যায় একই প্রশ্নে?
তাই পুরুষের একাংশ মহিলাদের এই উত্তরে যতই বিব্রত হন না কেন, এই পরিসংখ্যান তো অস্বীকার করার জো নেই। আর শুধু মহিলারাই যে এমনটা ভাবছেন, তাও বোধহয় নয়। একজন যেমন তাঁর স্বামীকে প্রশ্ন করেছেন, তাঁদের মেয়ের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি এলে তিনি কী বেছে নিতেন। দেখা গিয়েছে, সেই কন্যার পিতাও কিন্তু খানিক ভেবে মেনে নিচ্ছেন, ভাল্লুকের শর্তটিই বরং তিনি মানতে রাজি। অথচ ভাল্লুক ও মহিলা, এই দ্বন্দ্ব রাখলে তিনি বিন্দুমাত্র না ভেবে মহিলার পক্ষেই ভোট দিয়েছেন।
সত্যি বলতে, পুরুষ ও নারী দুয়ের সহাবস্থানেই এ সমাজের এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে যে একের প্রতি অপরের মনে এমন অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হল, তাকে নিছক অস্বীকার করে চললে তা কোনও দিনই মুছবে না। বরং সেই পরিস্থিতির শিকড়ে পৌঁছনোটাই জরুরি। এহেন কাল্পনিক প্রশ্নোত্তর সেই দায়িত্বের কথাই কিন্তু নতুন করে মনে করিয়ে দিল।