দাদা অঙ্ক কী কঠিন! যে বাঙালি কথায় কথায় অঙ্কভয়ে কাতরে উঠল, ভোট এলেই তার অঙ্কে লেটার মার্কস বাঁধা। আসন দখলের অঙ্কে কোন দল পাশ করবে আর করবে না, সে খাতা দেখার ভার বাঙালিই নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। লোকসভা ভোটের হাওয়ায় সেই পার্টিগণিত চর্চা করলেন সরোজ দরবার।
বাঙালি নাকি এমনিতে বেশ ডাকাবুকো। সংগ্রামে, বিপ্লবে, বিদ্রোহে সে বরাবরই দড়। সেই বাঙালি সবথেকে ভয় পায় কাকে? এক এবং অদ্বিতীয় উত্তর হল, কে সি নাগ। ওই চৌবাচ্চায় জল ঢোকা আর বেরোনোর হিসাবে নাকানিচোবানি খেয়ে যাদের শৈশব কেটেছে, তাদের আর ভয় না পেয়ে উপায় কী! বাঁশ যে কেন তৈলাক্ত হবে, আর বেয়াড়া বাঁদর কেন উঠবে আর নামবে, সে হিসাব বাঙালি কিছুতেই মেলাতে পারে না। অতএব অঙ্কে ভয়ের সিনড্রোম বাঙালিসত্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে, তা বোধহয় নেহাত অমূলক নয়। অথচ ভোটের সময় এলে সেই বাঙালি কী ইন্দ্রজালে যেন পালটে যায়। তখন অঙ্ক ছাড়া তার মাথায় আর কিছুই ঘোরে না। এই তো পাঁচ দফা শেষ হয়েছে। বাসে, ট্রামে, মেট্রো স্টেশনে, রেস্তরাঁ, চা দোকানে কান পেতে শুনুন। দেখা যাবে কী বিষম গণিত চর্চাই না নিরন্তর করে চলেছে বাঙালি!
আরও শুনুন:
পাপ, প্রায়শ্চিত্ত, উপবাস: ভোট যেন পঞ্জিকায় বাঁধা শাস্ত্রীয় ধর্মকর্ম
অঙ্কটা অবশ্য বেশ মজারই। নানা যোগফলে ৪২ মেলানো। সে তো পারম্যুটেশন, কম্বিনেশন করে হাজার একটা উপায় বের করা যায়। তবে বিষয়টা এত সহজ নাকি! একেবারে সেই গেছোদাদাকে পাওয়ার মতো ব্যাপার। আগে তো দেখতে হবে গেছোদাদা কোথায় আছেন, সেখানে পৌঁছলে গেছোদাদা কোথায় থাকতে পারেন ইত্যাদি। অতএব বিয়াল্লিশের অঙ্কটাও ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ে। বাঙালির তো সোজা হিসাব, যিনি যত টিভি দেখেন, তিনি তত রাজনীতি বোঝেন। আর যাঁরা কাগজের চারের পাতায় চোখ রাখেন তাঁদের তো ব্যাপারই আলাদা। এর মধ্যে যাঁরা আবার সরকার বদলের সাক্ষী থেকেছেন তাঁরা খানিক সুবিধাজনক অবস্থায়। অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে না! ফলত রাজনীতি চর্চার প্যাঁচে যে যত বেশি যত জড়িয়ে পড়েন, অঙ্ক তাঁর তত জটিল হয়ে পড়ে। সমর্থকদের জন্য বরং কাজটা অনেক সহজ। যে যার দলকে জিতিয়ে দিতে পারলেই বাঁচেন। আর যাঁদের জেতার সেভাবে সম্ভাবনা নেই, তাঁরা আঁক কষছেন কোন কেন্দ্রে দ্বিতীয় হবেন সেই ব্যাপারে। কিন্তু বঙ্গীয় রাজনীতি শাসন করেন আসলে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক। তাঁরা এত সহজ অঙ্কে খুশি নন। অতএব আগে দেখতে হবে, যে শাসক দল কত শতাংশ ভোট সাধারণত পকেটস্থ করতে পারে তার হিসাব। সেই গড়ের সঙ্গে মিশতে হবে অ্যান্টি-ইনকমব্যান্সির হাওয়া কোথায় কতখানি প্রবল। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে জনমুখী প্রকল্পের সুবিধা কতখানি প্রভাব ফেলছে। আর মধ্যে আবার আলাদা বন্ধনীতে ধরতে হবে সংখ্যালঘু কিংবা মহিলা ভোটব্যাঙ্ক। তাতেও যে হিসাব মেলে তা নয়! দেখতে হবে, বিরোধী দল আগের বিধানসভা বা বাই ইলেকশনে কোথায় কতটা ভোট বাড়াতে পেরেছে। তা যদি জানা যায়, তাহলে ভেবে দেখতে হবে সেই সেই জায়গায় বর্তমান প্রার্থী স্ট্রং নাকি রং। এর মধ্যে আবার আছে কাটাকুটির খেলা। অমুক যদি এত শতাংশ ভোট কেটে নিয়ে তমুককে সুবিধা করে দেয়, তাহলে এক লহমায় পুরো উত্তরমালাই বদলে যেতে পারে। সেখানেও শেষ নেই। মাথায় রাখতে হবে যে, স্থানীয় ইস্যু কতটা কার্যকরী হচ্ছে, তা ছাড়া প্রার্থীর নিজস্ব ঝলকানি আদৌ আছে কি না! অতএব পার্টিগণিত যে সহজে কষে ফেলা যাবে, তা তো নয়। ইফ-এলসের কোডিং-এর মতোই হিসাব ক্রমশ বদলাতে থাকে। এবং শেষ পর্যন্ত উত্তর যে মেলে তাও নয়। মাঝখান থেকে চা দোকানে কয়েক কাপ চায়ের সেল বেশি হয়।
আরও শুনুন:
যে রাঁধে সে রাজনীতিও করে! ভোটের হাওয়ায় পলিটিক্সের হেঁশেলনামা
এ যদি হয় রাজ্যের পর্ব, তাহলে পরের শক্ত অধ্যায় হচ্ছে দেশের হিসাবশাস্ত্র। সেখানেও একগাদা শর্ত। হিসাবের প্যাঁচ সেখানেও তো কম কিছু নয়। ভোটকুশলী যাঁরা, তাঁরা গড় হিসাব করেই সন্তুষ্ট। যদি শাসকদলের উত্তর পশ্চিমে ভোট কমেও থাকে, তাহলে পূর্ব বা দক্ষিণে হয়তো ভোট বাড়বে। মোটামুটি তাঁদের হিসাবখাতা এতেই খুশি। কিন্তু তাতে বাঙালির চলবে কেন! অতএব কেন চারশো বলা হয়েছিল, আর কেন তা হবে না, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ দরকার। অন্যদিকে ২৭২ হতে হতেও আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা যে থাকলেও থাকতে পারে, এমন অঙ্কও কষে ফেলেছেন কেউ কেউ। এদিকে জোটের আর জাতের অঙ্ক মিলিয়ে মিলিয়ে কেউ কেউ দেখছেন যে, বিরোধীদের দৌড় কতদূর। অতএব অঙ্ক এখানেও জটিল। যথারীতি কফি শেষ হয় কাপের পর কাপ, কিন্তু এখানেও উত্তর মেলে না।
তা মিলুক আর নাই মিলুক, অঙ্ক কষায় কিন্তু বাঙালির কমতি নেই। ইশকুলের পরীক্ষায় লেটার মার্কস থাক বা না-থাক, ভোটের অঙ্কে বাঙালি পিছিয়ে পড়বে এমন কোনও সম্ভাবনাই নেই। কে বলে, দাদা অঙ্ক কী কঠিন! একবার বাঙালির সঙ্গে শুধু ভোটের পার্টিগণিত চর্চা করে বরং দেখুনই না!