আকাশে রামধনু দেখেছেন। রঙিন নদীর গল্পও শুনেছেন। কিন্তু পাহাড়ের গায়ে এমন রঙের মেলা কখনও দেখেছেন কী! না, কেউ যত্ন করে পাহাড়ের গায়ে তুলি বোলাননি এখানে। কিন্তু দেখলে হাতে আঁকা বলে ভুল হতেই পারে। কিন্তু এক্কেবারে প্রাকৃতিক ভাবে রঙিন এই পাহাড়। কোথায় রয়েছে এমন রঙিন পাহাড়। আসুন, শুনে নিন।
ঠিক যেন হাতে আঁকা। কেউ যেন যত্ন করে তুলি বুলিয়েছেন পাহাড়ের বুকে। এঁকেছেন সাত রঙের আল্পনা। আকাশের বুকে এমন সাত রঙের খেলা তো কতই দেখেছি আমরা। জলের বুকে রঙের খেলা, তা-ও শুনেছি আমরা। কিন্তু পাহাড়ের গায়েও প্রকৃতি আঁকতে পারে এমনও রং। এ যেন আশ্চর্য। ব্যাপারটা অবাক করার মতো হলেও এমন রঙিন পাহাড় রয়েছে এই পৃথিবীর বুকেই। তাতে একই সঙ্গে খেলা করে নীল, লাল, হলুদ, কমলার মতো হাজারটা রং।
চিনের গাংসু প্রদেশের ঝাংগেতে রয়েছে ড্যানক্সিয়া ল্যান্ডফর্ম বা এই আশ্চর্য পাহাড়। খাতায় কলমে এ পাহাড়ের নাম রেড স্টোন পার্ক। তবে সব দিক থেকেই এর রামধনু পার্ক নামটাই যেন বেশি জনপ্রিয়। আর এ হেন রংমিলান্তির জন্যই পর্যটকদের কাছে দিনকে দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই রামধনু পাহাড়।
আরও শুনুন: সমুদ্রসৈকতের রং নাকি টকটকে লাল! পর্যটকদের বিস্মিত করে এই আশ্চর্য সৈকত
কিন্তু কেন এই পাহাড়ে দেখা মেলে এমন সাতরঙের। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, ক্রিটেসিয়াস যুগে নাকি প্রচুর পরিমাণে বেলেপাথর ও পলিপাথর জমা হয়েছিল চিনের এই ভূখণ্ডটিতে। তা অবশ্য প্রায় সাত-আট কোটি বছর আগের কথা। তখনও হিমালয় পর্বতামালা তৈরি হয়নি পুরোপুরি। তা এই বেলেপাথর আর পলিপাথরের সঙ্গে জমা হয়েছিল আয়রনের মতো প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ।
আনুমানিক সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে ভূমিকম্পের ফলে ভারতীয় প্লেটের সঙ্গে ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষ ঘটে। আর তার ফলেই বদলে গিয়েছিল ভূগর্ভের স্তরবিন্যাস। এককালে এই রামধনু পাহাড় আসলে ছিল বেলেপাথরের তৈরি সমতল। ওই ভূগর্ভস্থ প্লেটের সংঘর্ষের ফলেই ভাঁজ খেয়ে তৈরি হয়েছিল ওই পর্বতমালা।
পাশাপাশি আবহাওয়া ও ক্ষয়ের কারণে পাথরের ভিতরে অনবরত রাসায়নিক পরিবর্তন হচ্ছিল। যার জন্য বদলে যায় রং। তবে প্রাথমিট রংটা নাকি ছিল লালচেই, অর্থাৎ যা বেলে পাথরের আসল রং। বহু দিন ধরে আবহাওয়া, জল ও অক্সিজেনের সঙ্গে সংস্পর্শে থাকতে থাকতে রাসায়নিক পরিবর্তন হচ্ছিল পাথরের ভিতরে জমে থাকা খনিজ পর্দার্থের। আর তা-ই ওই পাহাড়ের এতগুলো রংয়ের জন্য দায়ী। ভাবছেন তো, সে আবার হয় নাকি! এমনি এমনি আবার তৈরি হতে পারে নাকি এত রকম রং।
আরও শুনুন: মেকি নয় সত্যি, গোলাপি জলের এই হ্রদ পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়
তবে জানেন কি, আয়রন বা লোহা নামক এই খনিজটি বাতাস, জল আর অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তৈরি করে আয়রন অক্সাইড বলে এক ধরণের যৌগ, যা আসলে লালচে রঙের জন্য দায়ী। ঠিক তেমনভাবেই লিমোনাইট বা গোথাইট নামক পদার্থদুটি বেলেপাথরের গায়ে বাদামী বা হলুদ দাগ তৈরি করতে সক্ষম। ম্যাগনেটাইট আবার কালো রংয়ের জন্য দায়ী। সবুজ রং উৎপন্ন করতে পারে ক্লোরাইট। আর এমনই সমস্ত নানা ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়াই নিয়ন্ত্রণ করেছে রামধনু পাহাড়ের রঙকে।
এই পাহাড়কে কেন্দ্র করে চিনের ওই এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি ইকোলজিকাল পার্কও। যা হাজার হাজার পর্যটকদের কাছে আজ অন্যতম একটি আকর্ষণ। ২০০৯ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকার আওতায় এসেছে এই অদ্ভুত রংধনু পাহাড়। পৃথিবীর এই আশ্চর্য প্রাকৃতিক রংমেলান্তি দেখতে চাইলে একবার ঘুরে আসতেই পারেন ঝাংগে থেকে।