নিজের মৃত্যুর বদলা নিয়েছিল নাকি খোদ নিহতই। যে হত্যা রহস্যের কিনারা করে উঠতে পারেনি পুলিশর গোয়েন্দারা, নিমেষেই তার সমাধান জানিয়ে দিয়েছিল খুন হওয়া মহিলার আত্মা। গল্পে নয়, বাস্তবেই নাকি ঘটেছিল এমন কাণ্ড। যার কোনও ব্যাখ্যাও দিতে পারেনি কেউ। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
কোনও হত্যাকাণ্ডের পর বসেছে প্ল্যানচেটের আসর। আর সেখানেই কারও উপর ভর করছে কোনও মৃত ব্যক্তির আত্মা। তার কথাতেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে জটিল রহস্যের পর্দা। হ্যাঁ, সিনেমায় এমন চমক দেওয়া দৃশ্য দেখা যেতেই পারে। কিন্তু যদি বলি, সিনেমায় নয়, বাস্তবেই ঘটেছিল এমন কাণ্ড? যেখানে মৃতের আত্মাই জানিয়ে দিয়েছিল প্রকৃত খুনির নাম, এমনটাই দাবি করেছিলেন তদন্তকারীরা?
আরও শুনুন: কিশোরীদের রক্তে স্নান, ৬০০ জনকে খুন, কুখ্যাত মহিলা সিরিয়াল কিলারের রুদ্ধশ্বাস গল্প
হ্যাঁ, শিকাগো শহরে ঘটে যাওয়া এক হত্যাকাণ্ডের সমাধান নাকি হয়েছিল এভাবেই। সমাধান, নাকি আরেক রহস্যের সূচনা, সে কথা অবশ্য বলা মুশকিল। নিজের ফ্ল্যাটেই খুন হয়েছিলেন এক মহিলা। গায়ে একটি সুতোও ছিল না। অথচ বিশেষজ্ঞরা জানান, যৌন হেনস্তার কোনও প্রমাণ মেলেনি। ঘটনার তদন্ত শুরু করেছিল পুলিশ, কিন্তু অপরাধীর ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি তারা। আর এই পরিস্থিতিতেই সম্পূর্ণ অপরিচিত এক সূত্র থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে আলো পড়ে এই রহস্যের উপর।
নাঃ, গোড়া থেকেই বলা যাক বরং।
দিনটা ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৭৭ সাল। শিকাগোর একটি অ্যাপার্টমেন্টে আগুন লাগার খবর গিয়েছিল দমকলের কাছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দমকল কর্মীরা দেখতে পান, আগুনের উৎস একটিই ফ্ল্যাট। বন্ধ দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে তাজ্জব হয়ে যান তাঁরা। ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, অথচ ঘরের ভিতরে তো কেউ নেই। আগুন নেভাতে গিয়ে একজন দেখতে পান, কিছু আসবাব, বিছানাপত্র অদ্ভুতভাবে জড়ো করা রয়েছে। ততক্ষণে সবকিছুকেই গ্রাস করেছে আগুনের লেলিহান শিখা। কোনওমতে আগুন নেভানোর পর তো সকলের চক্ষু চড়কগাছ! সবকিছুর নিচে চাপা পড়ে আছে কিনা এক যুবতীর দেহ! দেহে যে প্রাণ নেই সে কথা আর বলে দিতে হয় না, কারণ বুকে আমূল বিঁধে আছে একটি ছুরি। শরীরে নেই এক টুকরো কাপড়ও। জানা গেল, যুবতীর নাম তেরেসিটা বাসা।
আরও শুনুন: পুলিশের ঘুম ছুটিয়েছিল কলকাতার প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার
তদন্তে নেমে কিন্তু কার্যত চোখে অন্ধকার দেখছিল পুলিশ। শরীরে কোনও যৌন হেনস্তার চিহ্ন নেই। এদিকে প্রতিবেশী, বন্ধু সকলের সঙ্গেই সম্পর্ক ভাল বলে শোনা যাচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবনেও তেমন কোনও গোপন কথা নেই। জানা গেল, যুবতীর জন্ম ফিলিপাইন্সে। মেডিক্যালের ছাত্রী। কিন্তু নয়া অ্যাডভেঞ্চারের নেশাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায় সে। এখানে এসে একটি হাসপাতালে যোগ দিয়েছিল সে। সেখানেও খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, রুগি থেকে কর্তৃপক্ষ কারোরই তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। তাহলে খুনটা করল কে?
গোয়েন্দারা ধরেই নিয়েছিলেন, এ রহস্যের উত্তর মিলবে না। কিন্তু মাস ছয় পর হঠাৎ এক ফোন আসে গোয়েন্দা দপ্তরে। আর তাতেই জব্বর ব্রেক থ্রু। অথচ ফোনটা ধরে সে কথা আঁচ করেই পারেননি কেউ। কী করেই বা পারবেন? ফোন করেছেন ডঃ হোসে চুয়া। যাঁর সঙ্গে তেরেসিটার দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোনও সম্পর্কই নেই। কিন্তু তাঁর কথা শুনে তো গোয়েন্দারা হাঁ! জানা গেল, ওই ব্যক্তির স্ত্রীর উপরে নাকি ভর করেছে তেরেসিটার আত্মা। আর সেই আত্মার তাগাদার চোটেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পুলিশকে ফোন করে বসেছেন তিনি।
এমন একটা আষাঢ়ে গল্প পুলিশের পক্ষে কি বিশ্বাস করা সম্ভব? কিন্তু ওই ব্যক্তি নাছোড়বান্দা। তিনি জানান, তাঁর স্ত্রী রেমির সহকর্মী ছিলেন তেরেসিটা। রেমিও আদতে ফিলিপাইন্সের মেয়ে। তেরেসিটার মৃত্যুর পর একদিন হঠাৎই সে দেশের ভাষায় কথা বলে ওঠেন রেমি, কিন্তু দেখা যায় তাঁর কণ্ঠস্বর অন্যরকম। আর সেই কণ্ঠস্বরের মালিক দাবি করে, সে তেরেসিটা। তাকে খুন করেছে ওই হাসপাতালেরই এক কর্মী অ্যালান। কেন, কীভাবে সে খুন করেছে, সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেয় ওই কণ্ঠস্বর। যদিও তারপরেও চুপ করেই ছিলেন এই দম্পতি। কোনও প্রমাণ ছাড়া কী বলবেন তাঁরা পুলিশকে? ভূত ভর করার গল্প? কিন্তু দেখা গেল সেই কণ্ঠস্বর হাল ছাড়তে নারাজ। ঘন ঘন দম্পতিকে তাড়া দিয়ে পুলিশের কাছে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয় সে। কাজেই, শেষমেশ পুলিশের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হন ওই ব্যক্তি।
গল্পটা যতই আষাঢ়ে হোক, পুলিশের তখন খড়কুটো আঁকড়ে ধরার দশা। কোনওভাবেই যখন সমাধান মিলছে না, অ্যালান নামের ওই কর্মীকে তাহলে জেরা করে দেখাই যাক নাহয়। এই ভেবেই এগোন গোয়েন্দারা। আর আশ্চর্য, তাঁদের জেরার মুখে একসময় ভেঙে পড়ে ওই ব্যক্তি। স্বীকার করে, সেদিন তেরেসিটার বাড়িতে টিভি সারাতে গিয়েছিল সে। কিন্তু এক সুযোগে তেরেসিটার গয়নাগাঁটি দেখে ফেলে সে। চুরি করার জন্য হাত নিশপিশ করে ওঠে। আর সেই কারণেই এই খুন। চুরির কথা যাতে কেউ সন্দেহ না করে, সে কারণেই পুরো বিষয়টাকে যৌন হেনস্তার চেহারা দিতে চেয়েছিল সে। হোসে চুয়া-র কথা অনুযায়ী তেরেসিটার আত্মা যা যা বলেছিল, অ্যালানের জবানবন্দির সঙ্গে মিলে যায় তার সবকিছুই। এমনকি উদ্ধার হয় সেইসব চুরি করা গয়নাও। পুলিশের গোয়েন্দা যে রহস্যের সমাধান করতে পারেনি, সেই রহস্যের জাল ছিঁড়ে দেয় অশরীরী গোয়েন্দা। তবে তার ফলে যে নতুন রহস্যের জন্ম হয়, তার সমাধান করে উঠতে পারেননি কেউই।