পড়ানো ছাড়া আর কিছুই ভাললাগে না। তাঁর কথায়, বাড়িতে আর কোনও কাজ তিনি করেনও না। তাই বয়স যতই হোক, মানুষ তৈরির কাজ থামাননি এখনও। অবসর গ্রহণের পরও চালিয়ে যাচ্ছেন পড়ানোর কাজ। তবে মাত্র ২ টাকার মাইনের বিনিময়ে। তাও আবার মাসে নয়, বছরে। আসুন শুনে নিই, তাঁর কথা।
বয়স ৭৮। দুই সন্তানই প্রতিষ্ঠিত। স্বামী-স্ত্রী সংসারে কতটুকুই বা আর খরচ। তাই ছাত্রছাত্রীদের থেকে বছরে মাত্র ২ টাকা মাইনে নেন তিনি। প্রত্যন্ত গ্রামে এভাবেই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন আউশগ্রামের সুজিত চট্টোপাধ্যায়। আর এই মহানুবতার জোরেই পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
আরও শুনুন: এক রাতের খরচ ৬১ লাখ! কোন দেশে রয়েছে এমন বিলাসবহুল হোটেল?
ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক চিরকালই অন্যরকম। তার মধ্যে যেমন মিশে আছে খানিক ভয় তেমনই মিশে আছে অনেকটা শ্রদ্ধা। বাবা-মায়ের পর তো গুরুরই স্থান। পুরাণের গল্প হোক কিংবা কোনও মহানুভবের আত্মজীবনী। সব ক্ষেত্রেই উল্লেখ মেলে একজন গুরুর। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা জেরে অনেকেই যদিও এমনটা আর ভাবতে চাইছেন না। তবে সুজিত বাবুর গল্প সাম্প্রতিক সমস্ত ঘটনার ব্যতিক্রম। ৮০ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও তিনি যেভাবে মানুষ তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তা প্রশংসার উর্ধে।
আরও শুনুন: নাচের ছন্দে খসে পড়ত পোশাক, গুপ্তচর মাতা হারির শরীরী আগুনে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিত শত্রুরা
রামনগর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু অবসরের পর সময় কাটাত না কিছুতেই। তাই ঠিক করেন বাড়িতেই পড়ানো শুরু করবেন। প্রথমে তিনজন ছাত্রকে দিয়ে সেই অভিযানের শুরু। কিন্তু প্রথম থেকেই তার শর্ত ছিল, মাইনে নেবেন না। তবু গুরুদক্ষিণা হিসেবে কিছু না নিলেও নয়। তাই মাত্র ১ টাকায় পড়ানো শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে আশেপাশের গ্রামে তাঁর এই অভিযানের কথা ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে পড়ুয়ারা এসে ভিড় জমাতে শুরু করে তাঁর পাঠশালায়। এতজনকে বাড়িতে পড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই গ্রামেই একটি বাড়িতে সেই ব্যবস্থা করেন। খানিকটা স্কুলের ধাঁচেই সেই বাড়িটিকে গড়ে ফেলেন তিনি। সময় মতো ক্লাসে ঢোকা, নিয়ম মেনে পড়াশোনা, সবই চলত তাঁর পাঠশালায়। না দেন ‘সদাই ফকিরের পাঠাশালা’। টাকা-পয়সা নিয়ে কারও মনে যেন অহংকার না জন্মায়, সেই ভাবনা থেকেই এমন নাম রাখা। বর্তমানে তাঁর পাঠশালায় ৩৫০ পড়ুয়ার নিত্য যাতায়াত। বয়সের ভারে নুব্জ হলেও, তা ধরা পড়ে না তাঁর পড়ানোর কায়দায়। এখনও শক্ত হাতে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের পাঠ শেখান। তবে বেশ কিছু কারনের জন্য বর্তমানে মাইনে বাড়াতে হয়েছে তাঁকে। যদিও তা না বাড়ানোরই সমান। এতদিন পর মাত্র ১ টাকা মাইনে বাড়িয়েছেন তিনি। এখন তাঁর কাছে পড়তে গেলে বছরে ২ টাকা দিতে হয় পড়ুয়াদের। আর এতেই মাইলের পর মাইল পেরিয়ে তাঁর পাঠশালায় পড়তে হাজির হয় কেউ কেউ।
আরও শুনুন: ফুল, ফল বা মিষ্টি নয়! এই মন্দিরে পুজো দেওয়া হয় জ্যান্ত কাঁকড়া দিয়ে
শুধু আউশগ্রাম নয়, আশেপাশের এলাকাতেও তাঁকে একডাকে চেনে সকলে। তবে সুজিতবাবু হিসেবে নয়, তিইন সকলের ‘মাষ্টারমশাই’। বছর দুয়েক আগে ভারত সরকারের তরফে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়েছেন এই মহানুভব। স্রেফ কম টাকায় পড়ানো নয়, পড়ূয়াদের নিয়ে থ্যালাসেমিয়া সচেতনতার বিষয়েও কাজ করেন তিনি। দশজন থ্যালাসেমিয়া রোগিকে নিয়মিত সাহায্য করেন। আর এই সবকিছুর জোরেই মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন এই শিক্ষক। এলাকার প্রায় সকলেই তাঁর সামনে ভক্তিতে আর শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ান।