শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের মিহিদানার মতোই মোয়ার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জয়নগরের নাম। বর্তমানে শুধুমাত্র বাঙালির প্লেটে নয়, শীত পড়লেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায় ‘জয়নগরের মোয়া’। কিন্তু শুধুমাত্র জয়নগরই কেন? কী এমন বিশেষত্ব আছে এই স্থানের, যে এখানে ছাড়া আর কোথাও আসল মোয়া পাওয়াই যায় না! আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
মোয়া! নিতান্তই সাধারণ কিছু জিনিস দিয়ে তৈরি এক ‘অসাধারণ’ মিষ্টি। কথায় আছে, সারা বছর বাঙালিরা অপেক্ষা করে থাকে কবে শীতকাল আসবে? আর পাতে থুড়ি হাতে নলেনগুড়ের মোয়া আসবে! বিজ্ঞানের দয়ায় অন্যান্য মরশুমি সবজি বা ফল সারাবছর পাওয়া গেলেও, ‘মোয়া’ খেতে গেলে অপেক্ষা করতেই হয় বছরের শেষ কটি মাসের জন্য। বর্তমানে সারা বাংলা জুড়েই ‘মোয়া’ পাওয়া যায়, তবু তাঁদের বেশিরভাগেরই প্যাকেটে লেখা থাকে ‘জয়নগরের মোয়া’। বলাই বাহুল্য এই ‘জয়নগর’ ব্রান্ডের উল্লেখ না থাকলে অনেকে বিশ্বাসই করেন না যে সেই মিষ্টি আদৌ মোয়া কি না!
আরও শুনুন: পাকিস্তানে নববধূকে গাধা উপহার স্বামীর, কারণ জেনে মুগ্ধ নেটিজেনরা
তা কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে এই জয়নগরের?
সেকথা জানতে গেলে চলে যেতে হবে একেবারে মোয়ার জন্মলগ্নে। প্রাকৃতিকভাবে প্রত্যেকটি জায়গারই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। তেমনই এক বিশেষ গুণ রয়েছে এই জয়নগরের। কারণ এখানকার মাটিতেই চাষ হয় কনকচূড় নামে এক বিশেষ ধানের। আর মোয়া তৈরির ক্ষেত্রে এই বিশেষ ধানের খই-ই হলো প্রধান উপকরণ। এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পাওয়ার পর সরকারের তরফেও কনকচূড় ধান চাষের জন্য জয়নগর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিকেই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তবে মোয়ার জন্মস্থান হিসেবে নির্দিষ্টভাবে জয়নগর শহরটিকে মানতে চান না স্থানীয়রা। কারণ তাঁদের মতে মোয়ার জন্ম হয়েছিল জয়নগরের পাশের এক গ্রাম পঞ্চায়েত, বহড়ুতে। শোনা যায়, সেই গ্রামেই থাকতেন যামিনী নামে এক প্রৌঢ়। তাঁর খেতেই নাকি এই বিশেষ কনকচূড় ধানের চাষ হত। যামিনী একবার নতুন মিষ্টি বানানোর কথা ভাবেন। কিন্তু উপকরণ হিসেবে দামী জিনিস ব্যবহার করার সামর্থ তাঁর ছিল না। তাই জমিতে চাষ হওয়া কনকচূড় ধানের খই আর শীতের সকালে সদ্য তৈরি হওয়া নলেনগুড় মিশিয়ে এক মণ্ড তৈরি করেন তিনি। তারপর সেই মণ্ড থেকে নাড়ুর মতো আকারে এক মিষ্টি তৈরি করেন। যা খেয়ে ধন্য ধন্য করতে আরম্ভ করেন সকলে। কিছুদিনের মধ্যেই এক অনুষ্ঠান বাড়িতে সেই মিষ্টি পরিবেশন করেন তিনি। এবং এই নতুন মিষ্টির নাম দেন ‘মোয়া’। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এর আগে এমন মিষ্টি বানানোর কথা কেউ ভাবেননি। তাই সেই যামিনী-র হাতেই বহড়ু গ্রামে সর্বপ্রথম মোয়া তৈরি হয়েছিল বলে বিশ্বাস করেন অনেকে।
তাহলে জয়নগরের সঙ্গে মোয়ার নাম জড়াল কীভাবে?
আরও শুনুন: একটি আনারসের দামই ১ লক্ষ! কেন এমন আকাশছোঁয়া দাম, জানেন?
আসলে যামিনী-র তৈরি করা মোয়ায় খই আর নলেনগুড় ছাড়া উপকরণ হিসেবে আর কিছুই ছিল না। এমনকি তাঁর বানানো মোয়ার কোনও নির্দিষ্ট মাপও ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই জয়নগর অঞ্চলের মানুষ নিজেদের ঘরেই এই ‘মোয়া’ বানাতে শুরু করে দেন। ফলে ‘মিষ্টি’ হিসেবে মোয়ার গুরুত্ব কমতে থাকে। এই দেখে জয়নগরের পূর্ণচন্দ্র ঘোষ এবং নিত্যগোপাল সরকার নামে দুই মিষ্টি ব্যবসায়ী এক নতুন পরিকল্পনা করেন। তাঁরা বুদ্ধি করে মোয়া বানানোর সময় খোয়া ক্ষীর, ঘি, কাজু, কিশমিশের মতো আরও কিছু উপাদান যোগ করে সুদৃশ্য এবং সুস্বাদু একটি মিষ্টি তৈরি করেন। বলা বাহুল্য তাঁদের হাত ধরেই আজকের মোয়া-র জন্ম। তাঁরাই প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে মোয়ার উৎপাদন শুরু করেন। কয়েকবছর আগে এই মিষ্টি ‘জয়নগরের মোয়া’ হিসেবেই জি আই স্বীকৃতি পায়। যেহেতু আধুনিকভাবে বাণিজ্যিক স্বার্থে মোয়ার জন্ম জয়নগরের মাটিতে, তাই যে কোনও জায়গায় আসল মোয়া বলতে জয়নগরের মোয়াকেই। বাঙালির খাদ্যাভাসের সঙ্গে এমন ভাব জড়িয়ে গিয়েছে এই ইতিহাস যে, নামীদামি মিষ্টির দোকান এইখানে এসে গোল্লা পায়। মোয়া মানে জয়নগরই, বাঙালির কাছে এর অন্যথা হওয়ার কিন্তু জো নেই!